সাড়ে চার দশক আগের প্রমোদ দাশগুপ্তের ভূত এখন অমিত শাহের উপর ভর করেছে, বললে হয়তো বিধাতাও অলক্ষ্যে হাসবেন। কিন্তু রাজধানীতে এক বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাবে ইংরেজিকে একবগ্গা বিদেশি ভাষা ও বিদেশিদের ভাষা বলে দাগিয়ে দিলেন, তাতে এমনটা ভাবা ভুল হবে কি? ভারতে এমন এক সমাজের নির্মাণ অচিরেই হবে যখন ইংরেজি-বলা মানুষেরা লজ্জিত হবেন— অমিত শাহের এই মন্তব্য একাধারে আশঙ্কা ও আতঙ্ক জাগায়। আশঙ্কা, কারণ তাঁর দল ও সরকার শুধু ইংরেজি কেন, হিন্দি ছাড়া আর কোনও ভারতীয় ভাষাকেই যে গ্রাহ্য করে না তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে আসমুদ্রহিমাচল— দক্ষিণ ভারত, বিশেষত তামিলনাড়ু কেন্দ্রের ত্রিভাষিক নীতির বিরুদ্ধে যারপরনাই সরব; আর পূর্ব ও বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের ভাষাগুলিকে তো কেন্দ্র ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। মন্ত্রীর প্রকাশ্য ইংরেজি-বিরোধিতাকে তাই নিখিল ভারতীয় ভাষাপ্রেম ভেবে নিলে মস্ত ভুল হবে, কারণ কে না জানে, বিজেপির ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ প্রতিষ্ঠার পথে হিন্দি ছাড়া আর কোনও ভাষাই গ্রহণযোগ্য নয়— সে যতই ভারতের সংবিধানে বাইশটি স্বীকৃত বা ‘অফিশিয়াল’ ভাষা জ্বলজ্বল করুক, এমনকি তার মধ্যে একটি ইংরেজিও।
এর প্রতিবাদ হওয়ারই কথা, বিরোধীরা তা করেছেন। এ যুগে শুধু ভাল ভাবে খেয়েপরে বাঁচতেই নয়, নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শেখা জরুরি, ভারতীয়মাত্রেই এই সারসত্য বোঝেন। উনিশ শতকে বিদেশি শাসকের অধীনে ভারতীয়রা শুধু ইংরেজি ভাষা আয়ত্তই করেননি, নিজেদের অধিকার বুঝে নিয়ে স্বাধীনতা ও স্ব-ক্ষমতার পথে এগোতে তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন, শাসকের ভাষাতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। আজকের ভারতেও দরিদ্র শ্রেণি ইংরেজি শিখে জীবনে এগোক, প্রশ্ন করুক, বিজেপি তা চায় না বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্য— বিরোধী নেতার এই অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীপুত্র ও আইসিসি-প্রধান কি একাই তবে স্বদেশে-বিদেশে ইংরেজি বলবেন, কেন্দ্রের মন্ত্রীদের সন্ততিরাই শুধু বিদেশে পড়তে যাবেন, ডিএমকে নেতার এই প্রশ্নও অমূলক নয়; উত্তরও জানা।
ইংরেজি-বিরোধিতার মোড়কে আসলে হিন্দি ও হিন্দু রাষ্ট্রের বয়ানকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চারিয়ে দিলেন কি না সেই তর্ক চলুক, পাশাপাশি এই মন্তব্যের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যও বুঝে নেওয়া দরকার। ইংরেজি ‘বলা’র সঙ্গে ‘লজ্জা’ তথা অপরাধবোধের বিষয়টি জুড়ে দিয়ে অমিত শাহ আসলে ভাষিক বিভাজনকেই উস্কে দিলেন আরও। বহু ভাষা ভারতের সৌন্দর্য, শক্তিও; কিন্তু বিজেপি-শাসনে নানা মতের পাশাপাশি নানা ভাষাকেও দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দুর্বলতা বলে, এক দেশ এক ভোটের পাশে এক ভাষার জিগির তুলে ধ্বংস করা হচ্ছে বহুত্ববাদকে। এই আবহে ইংরেজিকে দুরমুশ করলে রাষ্ট্রীয় অভিসন্ধিই চরিতার্থ হয়; অন্য ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজি সম্পর্কেও লজ্জাবোধ তৈরি হলে হিন্দির পথ প্রশস্ত হয়। ভারত বিরাট দেশ, তার নানা রাজ্যের মানুষের মধ্যে যোগাযোগে হিন্দি কখনওই যথেষ্ট নয়, ইংরেজিই অনেক ক্ষেত্রে সকলের বোধগম্য ও কাজের ভাষা। বিশ্ব-অর্থনীতি ও সংযোগের প্রেক্ষিতে দেখলে ইংরেজির কোনও বিকল্প হতে পারে না; উন্নত বিশ্বের নানা দেশে, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের যে প্রতিভা ও কর্মদক্ষতা বহুচর্চিত, তার গোড়ায় রয়েছে চমৎকার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান। এই ভাষাকে বাহন করেই আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ভাবমূর্তি কাজ করে চলেছে কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক লাভের আশায়। সেই ইংরেজিকে নেতির আলোয় তুলে ধরলে, ধন্দ জাগে, বিশ্বের কাছে এই বার্তা যাবে যে একুশ শতকের ভারতমনটি সঙ্কীর্ণ, আত্মপর। ইংরেজিকে পায়ে ঠেলে একদা বাংলায় শাসক দল ও রাজ্যবাসীকেও বিপুল ভুগতে হয়েছিল, একুশ শতকে ফের সেই সিঁদুরে মেঘ কেন্দ্রের আকাশে দেখলে ভয় তো হবেই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)