ঠিক মাসতিনেকের ব্যবধান। এই বছরের ফেব্রুয়ারির গোড়ায় কেএমডিএ-র নিকাশি নালা সাফ করতে ভিতরে নেমেছিলেন এক ঠিকাশ্রমিক। তাঁর সাড়া না পেয়ে আরও দু’জন ভিতরে নামেন। অতঃপর বানতলা চর্মনগরীতে ভূগর্ভের বিষাক্ত গ্যাসে তিন জনই প্রাণ হারান। অথচ, তার দিনকয়েক পূর্বেই কলকাতা-সহ দেশের ছয় শহরকে ম্যানহোলে শ্রমিক নামানো নিয়ে সতর্ক করে শ্রমিক সুরক্ষা সম্পর্কিত একাধিক নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই নির্দেশে কর্ণপাত করার সদিচ্ছা তখনও দেখা যায়নি, এখনও না। সম্প্রতি প্রায় একই ধাঁচের দুর্ঘটনায় সেই কেএমডিএ-র কাজ করতে ভূগর্ভে নেমে প্রাণ হারালেন এক তরুণ। অসুস্থ হয়েছেন তাঁর বাবা ও কাকা। গঙ্গা অ্যাকশন প্রকল্পের পাম্প হাউসে জল বেরোনোর নর্দমার জালি পরিষ্কার করতে নেমেছিলেন তাঁরা, সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই, যেমনটি প্রতি বার হয়ে থাকে। এবং প্রতি বারের মতোই প্রকৃত নিয়োগকারীর দায় ঝেড়ে ফেলার অভ্যাসটিও অপরিবর্তিত থেকেছে। ফেব্রুয়ারির ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের উপরেই তাঁদের মৃত্যুর দায় চাপিয়েছিলেন স্বয়ং মেয়র ফিরহাদ হাকিম। এই বার কেএমডিএ দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থার উপরে দায় চাপিয়েছে।
ভারতে ২০১৩ সালে পাশ হওয়া আইনে নির্দিষ্ট ভাবে বলা হয়েছিল ম্যানহোল, সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার, মলমূত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ কোনও মানুষকে দিয়ে করানো যাবে না। শীর্ষ আদালতেরও নির্দেশ ছিল, বিশেষ প্রয়োজনে মানুষকে ম্যানহোলে নামাতে হলে সর্বাগ্রে দেখে নিতে হবে নীচে বিষাক্ত গ্যাস আছে কি না, মানুষ নামাতে হবে কোমরে দড়ি বেঁধে, আপাদমস্তক ঢাকা বিশেষ পোশাকে, পায়ে গামবুট, হাতে দস্তানা, মুখে মাস্ক-সহ, থাকবে অক্সিজেনের ব্যবস্থাও। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনায় স্পষ্ট, এই নিয়মের প্রায় কিছুই মানা হয় না। বিশেষ পোশাক তো দূর, সামান্য মাস্ক এবং দস্তানার সুরক্ষাটুকুও শ্রমিকরা পান না। বছর চারেক আগে কুঁদঘাটে ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশনের কাছে ম্যানহোলে কাজ করতে নেমে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সাত জন শ্রমিক। জানা গিয়েছিল, মাটির অন্তত ৩০ মিটার গভীরে নামানো হয়েছিল তাঁদের। এত গভীরে মানুষ নামিয়ে কাজ করানোও নিষিদ্ধ। কিন্তু এই বেআইনি কাজই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট মানববর্জ্য অপসারণ বা নালা-নর্দমা সাফ করতে গিয়ে শ্রমিক মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে ত্রিশ লক্ষ টাকা। কিন্তু কত জন শ্রমিক আইন অনুসারে টাকা পেয়েছেন? এই ধরনের কাজে সাধারণত ঠিকাদারের মাধ্যমেই লোক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু নতুন শ্রম বিধিতে এই ব্যবস্থায় একটি লক্ষণীয় ফাঁক বর্তমান। পূর্বে যেখানে কুড়ি জন কর্মী নিয়োগ করলেই ঠিকাদারকে সরকারের কাছে নাম নথিভুক্ত করতে হত, নতুন নিয়মে তা হয়েছে ঊনপঞ্চাশ। ঠিকাদার বৈধ না হলে তাঁর নিয়োগ করা কর্মীও অবৈধ, তদর্থে অসুরক্ষিত। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিবারের হাতে না পৌঁছনোর সম্ভাবনাটি প্রবল। অবিলম্বে এই বিষয়টিকে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে ঢাল-তরোয়ালহীন শ্রমিককে ভূগর্ভের কাজে ঠেলে দেওয়ার কুপ্রথাটিকে বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন আছে, নিয়োগকারী সমস্ত পক্ষকেই তার আওতায় আনা জরুরি। দায় ঠেলাঠেলি এবং সামান্য ক্ষতিপূরণে এই অপরাধ ঢাকা দেওয়া যাবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)