E-Paper

প্রত্যাঘাত

কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের নির্দেশে এ বারের পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠান তড়িঘড়ি বাতিল করে সাহিত্য অকাদেমির পূর্ণ স্বাধীনতায় শুধু হস্তক্ষেপই নয়, আঘাতও করা হল।

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৩

যেন সিনেমার দৃশ্য। বিচারকের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, শুধু রায়দান বাকি, সবাই অপেক্ষারত— এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এল এক চিঠি: সব বাতিল। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলন তথা গোটা অনুষ্ঠানটিই বাতিল হল গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে, এমন অতিনাটকীয় ভাবেই— কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের ‘নির্দেশ’-এ। তার আগে, সে দিনই সাহিত্য অকাদেমি, সঙ্গীত নাটক অকাদেমি, ললিত কলা অকাদেমি ও ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-কে চিঠি পাঠিয়ে কেন্দ্র মনে করিয়েছিল সরকারের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাক্ষরিত চুক্তির (মেমোর‌্যান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) কথা, যেখানে লেখা আছে, প্রতিষ্ঠানগুলির ঘোষিত পুরস্কারের পুনর্বিন্যাস বা ‘রিস্ট্রাকচারিং’-এর কাজ করতে হবে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে পরামর্শ করে, প্রতিষ্ঠানগুলি সেই লক্ষ্যে এ-যাবৎ কী পদক্ষেপ করেছে তা কেন্দ্রকে জানাতে হবে। এর পরেই, সব কিছু নির্ধারিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠান বাতিল হল।

অথচ এ কথা সকলের জানা, সাহিত্য অকাদেমি কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের ‘অধীন’ হলেও একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত’ প্রতিষ্ঠান, তার নিয়মবিধি থেকে শুরু করে পুরস্কার প্রদান প্রক্রিয়ার সব কিছুই তাদের নিজেদের নির্ধারিত, এবং এত কাল পূর্ণ স্বাধীনতায় অকাদেমি তা করে এসেছে। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে অকাদেমির এগজ়িকিউটিভ কমিটি একটি সর্বভারতীয় বিচারকমণ্ডলী ঠিক করে, বিচারকদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়, এগজ়িকিউটিভ বোর্ড তা মঞ্জুর করে মাত্র। সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে বোর্ডের তো বটেই, ‘বাইরে’রও কোনও হস্তক্ষেপ বাঞ্ছিত নয়। রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় সরকার বা অন্য যে কারও প্রভাব থেকে মুক্ত, সর্বময় স্বাধীনতাই এই প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের গোড়ার কথা— প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বক্তব্যটি স্মরণযোগ্য, “অকাদেমির সভাপতি হিসেবে আমি চাইব, প্রধানমন্ত্রী যেন আমার কাজে হস্তক্ষেপ না করেন।”

কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের নির্দেশে এ বারের পুরস্কার ঘোষণা অনুষ্ঠান তড়িঘড়ি বাতিল করে সাহিত্য অকাদেমির পূর্ণ স্বাধীনতায় শুধু হস্তক্ষেপই নয়, আঘাতও করা হল। এত কাল যা ছিল অভাবনীয় সেও ঘটল, চোখের সামনে। অবশ্য রাজনীতি-স্বাস্থ্য-শিল্প-বাণিজ্যের কথা বাদই থাক, শিক্ষা-সংস্কৃতির মতো ‘সফ্ট সেক্টর’গুলিও বর্তমান ভারতশাসকেরা যেমন আগ্রাসী ভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে চলেছেন, তাতে সাহিত্য অকাদেমির উপর এই আঘাত অবধারিত ছিল। অকাদেমি এগজ়িকিউটিভ বোর্ডের এক সদস্য এমনও বলেছেন, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রতিনিধি এক বোর্ড-সদস্য এ বারের পুরস্কার-প্রাপকদের নাম ‘পুনর্বিবেচনা’র কথা বলেছিলেন, বোর্ড তা প্রত্যাখ্যান করে। সে জন্যই কি অনুষ্ঠান বাতিল করানো হল— সম্ভাব্য পুরস্কার-প্রাপকদের মধ্যে হয়তো কেন্দ্রের অপ্রিয় এক বা একাধিক লেখক আছেন, সে কারণেই? সাম্প্রতিক কালে নানা পরিস্থিতিতে অকাদেমির কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্ক উঠেছে, কিন্তু এ বার যা হল তা সব ছাড়ানো। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্লজ্জ আগ্রাসী রূপটি বেরিয়ে পড়ল। দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদার সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতায় এমন আঘাত শুধু দুর্ভাগ্যেরই নয়, আশঙ্কারও। এই ভারতে এমনই বুঝি ‘নিয়ম’ হতে চলেছে তবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Literaure Government of India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy