বাঙালি স্বভাবতই অতীতবিলাসী। তার তেমনই একটি অতীতের অর্ধশতবর্ষ পূর্ণ হল শনিবার, ৯ অগস্ট। গত শতকের শেষ পর্যায়ে টেলিভিশন দেখেছেন, এমন কোনও বাঙালির পক্ষে তারিখটি ভুলে যাওয়া কঠিন— কারণ, কলকাতা দূরদর্শনে প্রতি বছর অগস্টেই বেশ হইচই করে পালিত হত কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিনটি, কলকাতা দূরদর্শনের জন্মদিন হিসাবে। এখনও হয় কি না, তা অবশ্য বেশির ভাগ লোকই বলতে পারবেন না, কারণ সেই তুমুল নস্টালজিয়ার দূরদর্শন চ্যানেলটি এখন আর তাঁরা দেখেন না। এখন মানে, অন্তত আড়াই-তিন দশক। ১৯৯১-এর উদারীকরণের হাত ধরে বাঙালির ঘরে যবে থেকে ‘কেবল টিভি’-র তারটি প্রবেশ করল, দূরদর্শন প্রীতির শেষও ঠিক সেই সময়েই। কেন, সে কারণ সন্ধান করতে গেলে আগে খোঁজ করতে হয়, দূরদর্শন নামক টেলিভিশন চ্যানেলটি— দিল্লি এবং কলকাতা, উভয় সম্প্রচারের ক্ষেত্রেই— মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিল কেন? কারণটি সহজ: বিকল্পের অভাব। ১৯৭০-এর দশকে ভারতে যখন টেলিভিশনের উত্থান হচ্ছে, তখন তার তুল্য আর কোনও বিনোদন ছিল না। দৃশ্য বিনোদনের জন্য সিনেমাহল বা থিয়েটারে যেতে হত; আর ঘরে বসে বিনোদন চাইলে ভরসা ছিল রেডিয়ো বা রেকর্ড প্লেয়ারের শ্রাব্য মাধ্যম। টেলিভিশন ভেঙে দিল দৃশ্য ও শ্রাব্য বিনোদনের মাধ্যমের অন্তর্বর্তী দেওয়ালটি— সুখী গৃহকোণ সেজে উঠল টেলিভিশন সেটে। অতঃপর, সেই চ্যানেলে যা সম্প্রসারিত হল, সেটাই হয়ে উঠল সাধারণের প্রাণের ধন।
উপভোক্তার মন অবশ্য কখনও তুষ্ট হয় না। তা যা পায়, চায় তার চেয়েও অধিক কিছু। ভিডিয়ো ক্যাসেট প্লেয়ার এবং ভিএইচএস টেপ এক ধরনের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, কিন্তু তা শুধু উচ্চবিত্তের ঘরে। অন্যদের মনে জমে উঠছিল শুধু অপূর্ণ ক্ষুধা। কখনও অ্যান্টেনায় বুস্টার লাগিয়ে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান ধরার চেষ্টা, কখনও দূরদর্শনের পরিসরেই একটি-দু’টি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানে সে ক্ষুধা যে সম্পূর্ণ মেটেনি, তার প্রমাণ মিলল আর্থিক সংস্কার-উত্তর সময়ে। মাসে কয়েকশো টাকার বিনিময়ে খুলে গেল বিনোদনের অন্তহীন পরিসর— দু’দশকের অভ্যাস ত্যাগ করে সরকারি দূরদর্শনের বদলে সেই বেসরকারি বিনোদন বেছে নিতে বেশির ভাগ মানুষেরই সময় লাগল সামান্যই। স্পষ্ট হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রের মতোই এখানেও ভালবাসা ছিল মূলত বিকল্প সুযোগের অভাবের ফল। বস্তুত, আজকের ওটিটি-যুগে স্যাটেলাইট টেলিভিশনও ক্রমে পর্যবসিত হচ্ছে অতীতের ধূসর স্মৃতিতে। কারণ, ওটিটি এনে দিয়েছে আরও এক ধাপ স্বাধীনতা— শুধু পছন্দসই অনুষ্ঠান দেখার স্বাধীনতা নয়; যে কোনও সময়ে, যে কোনও জায়গা থেকে একা দেখার স্বাধীনতা। বিনোদন সম্পূর্ণ ভাবে ব্যক্তিগত হয়েছে।
বিকল্প পরিসর খুলে যাওয়া মাত্র দূরদর্শনের সমূহ পরাভবের কারণ সন্ধান করতে চাইলে তাকাতেই হবে একটি অচলায়তনের দিকে। তার নাম সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণের ফাঁস ছিল প্রবল— এমনকি প্রসারভারতী নামক স্বশাসিত সংস্থা গঠনের পরেও। তার কিছু ভাল দিক ছিল, সে কথা অনস্বীকার্য। টেলিভিশনের উপরে কিছু সামাজিক দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল রাষ্ট্র। কিন্তু, তার উল্টো দিকটি ছিল অভিভাবক-সুলভ মানসিকতা। পরিবারের পরিসরে অভিভাবকরা যেমন স্থির করে দেন যে, শিশুদের জন্য কোনটি ঠিক আর কোনটি বর্জনীয়, টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র ঠিক সেই অভিভাবক হতে মনস্থ করেছিল। নাগরিককে নাবালক জ্ঞান করার অভ্যাসটি সব রাষ্ট্রেরই মজ্জাগত। দূরদর্শনের যুগ যেন তার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কোন অনুষ্ঠান রুচিসম্মত, আর কোন জিনিসটি নাগরিককে দেখতে দেওয়া চলে না, সবই নির্ধারিত হত সরকারি কর্তাদের বিবেচনা অনুসারে। সে হস্তক্ষেপ যে সর্বদাই প্রত্যক্ষ, তা নয়, কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ তৈরি করে দিয়েছিল এমন এক নৈতিক আধিপত্য যে, তা হয়ে উঠেছিল অলঙ্ঘনীয়। বিকল্পের অভাবে দর্শক মেনেও নিয়েছিলেন সেই নিয়ন্ত্রণ— বহু ক্ষেত্রে হয়তো অনুভবও করেননি সেই নিয়ন্ত্রণের চরিত্র। কিন্তু, উদারবাদের খোলা হাওয়া ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল, আধুনিক দর্শক কোনও ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হতে চায় না। বস্তুত, নাগরিক-জীবনের কোন পরিসরটিতে রাষ্ট্র ঢুকতে পারে না, দূরদর্শনের ঘটনাক্রম তার মোক্ষম উদাহরণ। কেউ বলতে পারেন, এই খোলা হাওয়ায় রুচির অবনমন ঘটেছে। হয়তো সত্যই ঘটেছে, কিন্তু নাগরিকের অপরুচির অধিকারও কি রাষ্ট্র কেড়ে নিতে পারে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)