E-Paper

দুর্ভাগ্যের বোঝা

‘ক্লাইমেট জাস্টিস’ বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অসাম্য দূর করার জন্য গৃহীত ন্যায্য বণ্টনের নীতি এখন ক্রমেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছে।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৩০

সুন্দরবনে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে বসা কোনও দ্বীপ থেকে, অথবা উত্তরাখণ্ডে হড়পা বানে ভেসে যাওয়া কোনও গ্রাম থেকে রাষ্ট্রের প্রতি যদি প্রশ্ন ভেসে আসে—‘এই দুর্ভাগ্য থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়ার, স্বাধীনতা অর্জনের পথ কী’— আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্র তার কী উত্তর দেবে? দেশ তাদের বলতে পারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলে ত্রাণের ব্যবস্থা হবে; পুনর্বাসনও হয়তো জুটে যাবে অনেকেরই। কিন্তু, সেই ত্রাণ তো ঘটে যাওয়া ক্ষতি আংশিক ভাবে পূরণ করে মাত্র— জন্মসূত্রে বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাতীত অন্য কোনও ভাবে যাঁরা এমন কোনও জায়গায় বাস করেন, যেখানে হয় সুনিশ্চিত বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে; বা যেখানে বেঁচে থাকার প্রাত্যহিকতা এমনই শ্রমসাপেক্ষ, এমনই কঠিন যে, অন্য কোনও জায়গার সঙ্গে তার তুলনাই চলে না, সেখানকার মানুষদের সুযোগের ঘাটতি পূরণ হবে কোন পথে? ‘ক্লাইমেট জাস্টিস’ বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অসাম্য দূর করার জন্য গৃহীত ন্যায্য বণ্টনের নীতি এখন ক্রমেই আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর আট দশক পূর্ণ করতে ভারতের মাত্র আর দুই বছর বাকি। এখনও যদি নাগরিকের এই প্রশ্নের সদুত্তর রাষ্ট্রের কাছে না থাকে, তা হলে আর কবে?

বণ্টনের ন্যায্যতার দর্শনে এই প্রশ্নটি উঠতে আরম্ভ করেছে অন্তত গত সাড়ে চার দশক ধরে। অবশ্য, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদের সাপেক্ষে নয়, বৃহত্তর অর্থে ভাগ্যের প্রশ্নে। ভাগ্য, অর্থাৎ যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের অতীত। ভারতের রাষ্ট্রনীতিতে এই প্রশ্নটির উত্তরও খোঁজা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। যেমন, শিক্ষাক্ষেত্রে অথবা সরকারি চাকরিতে বিশেষ ভাবে সক্ষম প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাতীত। অথচ, সেই প্রতিবন্ধকতা তাঁদের পিছিয়ে দেয় জীবনের দৌড়ে— যেমন, যিনি দৃষ্টিশক্তিরহিত, তিনি কোনও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষের সমান মেধার অধিকারী হয়েও তাঁর প্রতিবন্ধকতার কারণেই পিছিয়ে থাকেন বহু ক্ষেত্রে। এমনকি, শিক্ষার সম্পদ সমান ভাবে বণ্টিত হলেও প্রতিবন্ধকতা তাঁর সমান ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা। তেমনই, আজ ভাবতে হবে যে, যাঁরা প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদের বা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেই অসুবিধাটিও এক অর্থে তাঁদের ভাগ্যই— নিয়ন্ত্রণাতীত। এমনকি, তাঁরা অন্যত্র অভিবাসী হলেও পূর্বজন্মের পাপের মতো জলবায়ু-বিপর্যয়ের বোঝা তাঁদের বয়ে চলতেই হয়। অভিবাসনের স্থানেও তাঁরা দরিদ্রতম, অনেক ক্ষেত্রেই মাথার উপরে পাকা ছাউনিটুকুও নেই, ফলে উন্নয়নের সুযোগও খর্বিত।

দুর্ভাগ্যের বোঝা যাতে উন্নয়নের পথে বাধা না হয়, জলবায়ু-বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও এমন ‘লাক ইগ্যালিটেরিয়ান’ নীতি প্রয়োজন। তার জন্য সবার আগে সমস্যাটির গুরুত্ব স্বীকার করতে হবে। তার পর প্রয়োজন এই বিপদের মানচিত্র তৈরি করার— স্থানগুলিকে চিহ্নিত করা, বিপদের তীব্রতা অনুসারে গুরুত্ব নির্ধারণ, এবং বিপন্ন জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যেও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বা অন্য কোনও মাপকাঠিতে বিপন্নতার তারতম্য নির্ধারণ করা। তার পর, সেই চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জন্য এমন উন্নয়ন নীতি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে জলবায়ু-বিপর্যয়ের বিপদের বোঝা বইবার দায়ে তাদের পিছিয়ে থাকতে না হয়। আজও যদি ভারতীয় রাষ্ট্র এই ন্যায্যতার গুরুত্ব না বোঝে, তা হলে স্বাধীনতা শব্দটি সর্বজনীন হবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Climate Crisis Environment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy