সাম্প্রতিক কালে ভূরাজনৈতিক পরিসরে কিছুটা কোণঠাসা ভারত। গত বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান এবং এ বছর পাকিস্তানের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি সামরিক সংঘাতের পরে, দুই পড়শি রাষ্ট্রের চিনের সঙ্গে সখ্য বৃদ্ধি অস্বস্তি বাড়িয়েছিল দিল্লির। এর মধ্যে ফিলিপিনসের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সাম্প্রতিক ভারত সফর কি কিছুটা স্বস্তি জোগাল দিল্লির অলিন্দে? বস্তুত, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনের মাঝে এই সফর দুই দেশের সামনের চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে আলোচনার এক সুযোগ করে দিল। ২০২২ সালে দেশের দায়িত্বগ্রহণের পরে প্রথম ভারত সফরে এসে দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতাকে আরও জোরদার করার উদ্দেশ্যে কৃষি সহযোগিতা, পরিকাঠামো, সংযোগ-সহ হরেক ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরও করেন ফিলিপিনসের প্রেসিডেন্ট। অন্য দিকে, ফিলিপিনসের সঙ্গে এ-হেন সম্পর্ক ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি, ‘ভিশন মহাসাগর’ এবং এক বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
লক্ষণীয়, প্রেসিডেন্ট মার্কোসের সফরকালেই ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ চিন সাগর অঞ্চলে ফিলিপিনসের নৌবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রথম যৌথ নৌমহড়া পরিচালনা করল, যা ভাল চোখে দেখেনি বেজিং। বস্তুত, ফিলিপিনসের সঙ্গে বিতর্কিত দ্বীপের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ২০১৬ সালে ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (ইউসিএলওএস)-র মামলায় হেরে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত চিনের নৌ-আগ্রাসনের সম্মুখীন হতে হয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। ভারতও ২০১৬ সালের ইউসিএলওএস মামলার রায়কে ফিলিপিনসের পক্ষে সমর্থন করেছে, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বহুপাক্ষিক শৃঙ্খলার প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের কাছে দক্ষিণ চিন সাগর সমস্যা কোনও প্রান্তিক সমস্যা নয়, বরং, এটি তার সামুদ্রিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি আঞ্চলিক নেতৃত্বের দাবির অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাভাবিক ভাবে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ‘চিন ফ্যাক্টর’-এর জেরেই আজ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা অংশীদারি দিল্লি ও ম্যানিলা-র কৌশলগত জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফিলিপিনসই হল প্রথম রাষ্ট্র যে ভারতের কাছে থেকে ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র আমদানি করতে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতের থেকে ভবিষ্যতে আরও সামরিক সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনা রয়েছে ম্যানিলার। নিরাপত্তার বাইরে এই কৌশলগত পুনর্বিন্যাস অ-সামরিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে। দুই দেশ ভারতীয় পর্যটকদের জন্য ভিসা-মুক্ত প্রবেশ এবং ফিলিপিনো নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে ই-ভিসা ঘোষণা করেছে। দ্বিপাক্ষিক পর্যটন এবং যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য দিল্লি ও ম্যানিলার মধ্যে সরাসরি বিমান পরিষেবারও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
আগামী বছর শুধু আসিয়ান-এর সভাপতিত্বই নয়, ‘আসিয়ান-ইন্ডিয়া কমপ্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এরও দায়িত্ব পালন করতে চলেছে ফিলিপিনস। তাই এই সফরটি মনে করিয়ে দেয় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি ভারতের আগ্রহ কেবল কোয়াড গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৃহত্তর বিশ্বব্যাপী শক্তিগুলির সঙ্গে বর্তমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে, দিল্লি এই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে উদ্যোগী।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)