পশ্চিমবঙ্গের সরকারি এবং সরকারপোষিত স্কুলগুলির দীনদশা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত কয়েক বছরে সরকারি বদান্যতায় তা যেন নিত্যনতুন অতল স্পর্শের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাতেও অবশ্য রাজ্য সরকারের স্কুলশিক্ষা নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষায় ভাটা পড়েনি। সম্প্রতি তারা নতুন আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে আরও বেশি সংখ্যায় ইংরেজি মাধ্যম চালু করার ক্ষেত্রে। তাদের ধারণা, সরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার প্রবণতা এর মাধ্যমে হ্রাস পেতে পারে। গত কয়েক বছরে বেশ কিছু বাংলা মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সেই স্কুলগুলি ভাল ভাবে চলছে, ছাত্রসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব, সেই সমীকরণই অন্যত্র চলুক— ভাবখানা এমনই।
অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে সড়গড় হওয়া জরুরি। বামশাসনে ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে করা ঐতিহাসিক ভুলের মাসুল এই রাজ্যের একাধিক প্রজন্ম দিয়েছে। কিন্তু, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা, যার উপর এখনও এক বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নির্ভরশীল, এবং যেখানে ‘নেই’-এর তালিকাটি ভয়ঙ্কর রকম বড়, সেখানে কোনটি অগ্রাধিকার পাবে— সেই ভাবনা সর্বাগ্রে জরুরি ছিল। বাংলা মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠন শুরুর চেয়েও ঢের বেশি জরুরি কাজ আছে। বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে সামঞ্জস্য বিধান, মিড-ডে মিলে পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা ইত্যাদি, যা এখনও যথেষ্ট অবহেলিত। সেগুলির দিকে বিন্দুমাত্র মন না দিয়ে শুধুমাত্র মাধ্যম পরিবর্তন করে ছাত্রদের বিপরীতমুখী যাত্রা আটকানো যাবে, এই চিন্তার মধ্যেই এক অবিশ্বাস্য ছেলেমানুষী রয়েছে। অভিভাবকরা কেন সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠান, কর্তারা সে কথা জানেন কি? শুধু আর একটু ভাল ইংরেজি শেখানোর জন্য নয়; অকারণ ছুটি, শিক্ষকের অভাব, এবং তাঁদের নানাবিধ সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকা প্রভৃতি কারণে সরকারপোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে পঠনপাঠনে যে তীব্র ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়, বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল তার থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ।
কয়েক দশক আগেও বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে ইংরেজি শিক্ষার ভিত্তিটি যথেষ্ট পোক্ত ছিল। সেই শিক্ষায় শিক্ষিতদের অনেকেই কর্মজীবনে সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, প্রচলিত কাঠামোতেও ইংরেজি শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করা সম্ভব, তার জন্য রাতারাতি মাধ্যম পরিবর্তনের আবশ্যকতা নেই। বরং, ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠন চালু হলে দায়িত্ব নেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রতিটি স্কুলে পাওয়া যাবে কি না, সেই সমীক্ষা করুক রাজ্য সরকার। এক দিকে নতুন নিয়োগ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা, অন্য দিকে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা ব্যবস্থায় সাধারণ পঠনপাঠন চালানোই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অনেক স্কুলে মাত্র এক বা দু’জন শিক্ষকের ভরসায় চলছে দৈনন্দিন কাজকর্ম। এই পরিস্থিতিতে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে কী করে? যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের দিয়ে কোনও ক্রমে কাজ চালিয়ে নেওয়া— এমনটা নিশ্চয়ই কোনও সভ্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হতে পারে না। অবশ্য শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেও যে প্রশাসন দলীয় তহবিল ভরানোকে গুরুত্ব দেয়, তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাকাশ এখন সেই আঁধারেই আচ্ছন্ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)