জাতীয় শিক্ষানীতি (২০২০) কার্যকর করার নির্দেশ কোনও রাজ্যকে দেবে না সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্যগুলির অধিকার রয়েছে নিজস্ব নীতি প্রণয়নের, কেন্দ্রের নীতির গ্রহণ অথবা বর্জন করার। যা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়, শীর্ষ আদালতের তাতে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্তটি আরও এক বার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব সীমা মেনে চলার গুরুত্বকে মনে করিয়ে দিল। আদালতের দায়িত্বের পরিধি নির্দেশ করে বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি আর মহাদেবন বলেন যে, যদি জাতীয় শিক্ষানীতি বিষয়ে কোনও রাজ্যের কাজে, অথবা নিষ্ক্রিয়তায়, কোনও নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, তা হলেই আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে, নচেৎ নয়। তামিলনাড়ুর স্কুলে হিন্দি না শেখানোর বিরোধিতা করে দায়ের হওয়া যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই অবস্থান গ্রহণ করল, সে মামলাটি আদালত খারিজ করেছে। তাতে অবশ্য প্রশ্নটির গুরুত্ব লঘু হয়নি। ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষার সঙ্গে একটি তৃতীয় ভাষা শেখানোর সুপারিশ করছে জাতীয় শিক্ষানীতি। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের মতে, এ হল স্কুল শিক্ষায় হিন্দি আরোপের চেষ্টা, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপন্থী। তাঁর এই অবস্থানের মূলে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। শিক্ষা যে-হেতু যৌথ তালিকার বিষয়, সে-হেতু রাজ্যের মানুষের রুচি, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা অনুসারে স্কুলের পাঠ্যক্রম তৈরির অধিকার রাজ্য সরকারের রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র সব রাজ্যকে একই নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য করতে পারে না। শীর্ষ আদালতে জাতীয় শিক্ষানীতি তামিলনাড়ুতে কার্যকর করার নির্দেশ প্রার্থনা করার অর্থ, ঘুরপথে রাজ্যের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের চেষ্টা। যা আদালত সঙ্গত ভাবেই প্রতিহত করেছে।
রাজ্যগুলি জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করল কি না, তা একটি ‘জটিল সমস্যা’ (ভেক্সড ইস্যু) বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতিরা। তবে নয়া শিক্ষানীতির ভাল-মন্দ নিয়ে আলোচনার মধ্যে ঢুকতে অস্বীকার করেছেন তাঁরা। সরকারি নীতির যথার্থতা নিয়ে বিচার-বিবেচনায় আদালতের এমন আপত্তির বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, নর্মদায় বড় বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করে মামলা করলে শীর্ষ আদালত জানায় যে, পরিকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প হবে কি না, হলে তা কেমন হবে, সে সবই প্রশাসনিক নীতির প্রশ্ন। সে বিষয়ে বিচার-বিবেচনার দক্ষতা আদালতের নেই। তবে প্রকল্প রূপায়ণের প্রক্রিয়ায় কোনও আইন ভঙ্গ হল কি না, কারও অধিকার লঙ্ঘিত হল কি না, সংবিধানের সীমার মধ্যে তা আদালত দেখবে (নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন বনাম ভারত সরকার, ২০০০)। অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক নীতির ভাল-মন্দ বিচার থেকে শীর্ষ আদালত বিশেষ ভাবে সরে থেকেছে। একাধিক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মনে করিয়েছে যে, নীতি প্রণয়ন বিশেষজ্ঞদের কাজ। বহু বিবেচনার পর তৈরি করা নীতিতে আদালত হঠাৎ কোনও বদল আনলে তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে, লাভের চেয়ে ক্ষতি হতে পারে বেশি।
তবে এই রায়ের প্রধান তাৎপর্য গণতন্ত্রের সুরক্ষায়। আইনসভা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার উপর ভারতীয় সংবিধান বিশেষ করে জোর দিয়েছে, এবং প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকেই আপন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব দিয়েছে। নীতি প্রণয়ন প্রশাসনের ক্ষেত্র। নীতি যদি সংবিধানসম্মত হয়, এবং তার রূপায়ণ করার সময়ে যদি নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘিত না হয়, তা হলে আদালতের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। শীর্ষ আদালতের এমন এক-একটি রায় গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। নরেন্দ্র মোদী সরকার যদি এই পরিমিতি-বোধের পরিচয় দিত, রাজ্যগুলির স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করত, তা হলে কেন্দ্রের আইন বা নীতিগুলির প্রতি রাজ্য সরকারের, এবং নাগরিক সমাজের, এত প্রতিরোধ দেখা যেত না। সংযমেই ক্ষমতার যথার্থ পরিচয়, তা মনে করাল সুপ্রিম কোর্ট।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)