E-Paper

রাজনীতির উৎসব

এ যেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দর্শন— প্রথমে মানুষের শেষ সম্বলের পুঁটলিটুকু নিয়ে দৌড় দেওয়া, এবং তার পর সেটুকুই ফিরিয়ে দেওয়াও ‘দুঃখীকে সুখ দেওয়ার একটি উপায়’।

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৫২

সবই আসলে রাজনীতির উৎসব, অন্তত প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এ বারের জিএসটি সংস্কারও শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হল রাজনৈতিক দাবির সমারোহে। অনস্বীকার্য যে, বহু পণ্যে জিএসটি-র হার কমানোয় ক্রেতার সুবিধা হবে। জিএসটি-র মতো পরোক্ষ কর চরিত্রে সর্বদাই ‘রিগ্রেসিভ’— যেহেতু আয়-নির্বিশেষে সবাইকেই এই কর সমান হারে দিতে হয়, তাই আয় যত কম, আয়ের অনুপাতে এই করের বোঝা মানুষের উপরে তত বেশি। এই করের হার কমলেই মঙ্গল। অন্য দিকে, জিএসটি-র হারের স্তর যত কম হবে, ব্যবস্থাটিও তত সরল হবে, ফলে সংস্থাগুলির ‘কমপ্লায়েন্স’-বাবদ ব্যয় কমবে। জিএসটি প্রবর্তনের আট বছর পরে হলেও সরকার করের হার কমানোর, এবং স্তরের সংখ্যা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রশ্ন হল, নিজেদেরই চালু করা করের উচ্চ হার কমিয়ে নিজেই কৃতিত্ব দাবি করা যায় কি? প্রধানমন্ত্রী যে ‘বচত’ অর্থাৎ সঞ্চয়ের কথা বলছেন, সেটি কিসের উপরে? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে জিএসটি-র হার ১৮% থেকে কমে শূন্য হয়েছে। অর্থাৎ, বছরে ৩০,০০০ টাকা প্রিমিয়াম, এমন একটি বিমার ক্ষেত্রে আগে জিএসটি ছিল ৫,৪০০ টাকা— এখন সে টাকাটি বাঁচবে। তা, এত দিন অবধি এই ৫,৪০০ টাকা কর কি ঔপনিবেশিক শাসকরা আদায় করছিলেন, না কি জওহরলাল নেহরু? কেন স্বাস্থ্যবিমার মতো একটি অতি জরুরি পরিষেবার উপরে এত দিন ১৮ শতাংশ হারে কর আদায় করা হচ্ছিল, সে পাল্টা প্রশ্নের জবাব প্রধানমন্ত্রী দেননি। মনে হয়, এ যেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দর্শন— প্রথমে মানুষের শেষ সম্বলের পুঁটলিটুকু নিয়ে দৌড় দেওয়া, এবং তার পর সেটুকুই ফিরিয়ে দেওয়াও ‘দুঃখীকে সুখ দেওয়ার একটি উপায়’। জিএসটি-র হার কমার ফলে বছরে মোট কত টাকা সঞ্চয় করতে পারেন এক জন সাধারণ মানুষ, রাহুল গান্ধী তার একটি অঙ্ক বলেছেন। কোন হিসাবে তিনি সেই অঙ্কে উপনীত হলেন, জানা নেই। তবে, কোনও হিসাবেই ‘বচত’-এর পরিমাণটি এত বেশি নয় যাতে ‘উৎসব’ করা চলে। অবশ্য, প্রধানমন্ত্রীর অভীষ্ট এই উৎসবটি নিতান্তই রাজনীতির।

জিএসটি প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী ‘স্বদেশি’-র কথা বলেছেন— পুঁজি যে দেশেরই হোক, ভারতে পণ্য উৎপাদন হলেই তা স্বদেশি। একবিংশ শতকে এই সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তির কোনও কারণ নেই। প্রশ্ন অন্যত্র। চিন বহু দূরের তারকা— উৎপাদনের লড়াইয়ে ভারত যে ক্রমে ফিলিপিনস বা ভিয়েতনামের মতো দেশের চেয়েও পিছিয়ে পড়ছে, তার কারণ হল এ দেশে উৎপাদন-বান্ধব পরিবেশ নেই, পরিকাঠামোও নেই। সাঙাততন্ত্রের দৌলতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রটি শেষ অবধি একচেটিয়া ব্যবসায় পরিণত হবে, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্য দিকে, ভারতের শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ অনুৎপাদনশীল— আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ক্ষেত্রে তারা কার্যত নিয়োগযোগ্যই নয়। ভারতে উৎপাদন ব্যয়ও তুলনায় বেশি। ফলে, ভারতে উৎপাদিত পণ্য বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় পায়ের নীচে যথেষ্ট জমি পায় না। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নামক প্রকল্পটি যে এত দিনেও যথেষ্ট সফল হল না, তা এই বাস্তবেরই প্রতিফলন। এই সমস্যাগুলির সমাধান না করে ‘স্বদেশি’র কথা বললেই কি পরিস্থিতি পাল্টাবে? ঘটনা হল, অটোমোবিলের মতো কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারতে বড় মাপের আন্তর্জাতিক পুঁজি আসছে, বা সেই প্রতিশ্রুতি মিলেছে। সেই উৎপাদনের একটি অংশ যাবে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু, সেই বাণিজ্যের লভ্যাংশ ভারতে পুনর্নিয়োজিত হবে না, তা ফিরে যাবে সংস্থাগুলির দেশে। দ্বিতীয়ত, অটোমোবিলের মতো ক্ষেত্রে উৎপাদন অতি প্রযুক্তিনিবিড়— ফলে, সেই লগ্নিতে কর্মসংস্থানেরও বিপুল বৃদ্ধি ঘটার আশা সীমিত। এই কথাগুলি খুব জটিল নয়, ফলে প্রধানমন্ত্রীও সম্ভবত কথাগুলি জানেন। কিন্তু, উৎসব যেহেতু রাজনীতির, ‘স্বদেশি’ শব্দটির এহেন অপব্যবহারে কারও কোনও আপত্তি এখনও শোনা যায়নি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Health scheme GST Investment Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy