Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Gautam Navlakha

প্রকৃত গরল

সরকারি ক্ষমতার সুযোগে যারা কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে তারাই দেশের পক্ষে বিপজ্জনক, তাদের দুর্নীতি দেশের পক্ষে ধ্বংসাত্মক।

গৌতম নওলাখা।

গৌতম নওলাখা। প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২২ ০৭:০৭
Share: Save:

আমি বলব, কারা দেশকে ধ্বংস করতে চায়? দুর্নীতিগ্রস্তরা— কথাটি জনসভায় শোনা যায়নি, বিতর্কের আসরেও নিক্ষিপ্ত হয়নি, এই তীব্র মন্তব্য উচ্চারণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম জোসেফ। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বন্দি মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখাকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। দু’বছরের বেশি তিনি কারারুদ্ধ, বিচার এখনও শুরু হয়নি। তিনি বয়সে প্রবীণ, স্বাস্থ্যও ভাল নয়। এই পরিস্থিতিতে আদালত তাঁকে নিজের বাড়িতে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব দিলে সরকারি আইনজীবী আপত্তি জানিয়ে বলেন, সেটা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক হবে। তার উত্তরেই বিচারপতি জোসেফের ওই ‘মৌখিক’ প্রতিক্রিয়া। তাঁর বক্তব্য, অভিযুক্তের গতিবিধির উপর প্রশাসন যেমন প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ জারি করুক, কিন্তু তাঁকে গৃহবন্দি রাখতে আপত্তি কিসের? কোন হিসাবে তিনি দেশের পক্ষে বিপজ্জনক? এই প্রশ্নের সূত্র ধরেই তাঁর ক্ষুব্ধ উক্তি: সরকারি ক্ষমতার সুযোগে যারা কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে তারাই দেশের পক্ষে বিপজ্জনক, তাদের দুর্নীতি দেশের পক্ষে ধ্বংসাত্মক।

বিচারপতিদের চূড়ান্ত বাক্‌সংযমের শর্তকে যাঁরা অলঙ্ঘনীয় মনে করেন, তাঁরা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু, পরিস্থিতি কোথায় পৌঁছলে প্রাজ্ঞ ও ভূয়োদর্শী বিচারপতিকে এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়? যে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতির প্রসঙ্গ তিনি তুলেছেন, তার সারবত্তা এবং গুরুত্ব নিয়ে কি আজ আর কোনও চক্ষুষ্মান নাগরিক বিন্দুমাত্র দ্বিমত পোষণ করেন? এবং, লক্ষণীয়, তিনি এই দুর্নীতিকে নিছক অন্যায় বা অনৈতিক বলে ক্ষান্ত হননি, দেশের পক্ষে বিপজ্জনক বলে গণ্য করেছেন। এই বক্তব্য কেবল সঙ্গত নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনীতিক, আধিকারিক বা কর্মী যখন দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তখন তাঁদের আচরণ কেবল নীতিগত আদর্শ ভাঙে না, সরকারি কাঠামোটিকেই আঘাত করে। সেই কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে আস্থা এবং বিশ্বাসের উপরে। সরকার জনসাধারণের অছি হিসাবে তার যাবতীয় কাজ সম্পাদন করবে, এটাই গণতন্ত্রের ধর্ম। দুর্নীতি সেই ধর্মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অথচ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সরকারি কাজে দুর্নীতির প্রকোপ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এই ব্যাধি রাষ্ট্রকাঠামোকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে, যে কোনও বাইরের বিপদের থেকে সেই অন্তর্ঘাত বহুগুণ বেশি বিপজ্জনক। বিচারপতির সিদ্ধান্তটি অব্যর্থ।

রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ামকরা কি আজ আর এই বিপদকে বিপদ বলে মনে করেন? তেমন ভরসা কোথায়? দৃশ্যত, তাঁদের অনেকের কাছেই দুর্নীতি তখনই খারাপ, যখন প্রতিপক্ষ তার সুযোগ নেয়। নিজেদের লোকেরা দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলেও দলনেতা বা দলনেত্রীদের কিছুমাত্র যায় আসে না, যত ক্ষণ না সেই দুর্নীতি ধরা পড়ে। এমনকি, হাটে হাঁড়ি ভাঙার পরেও তাঁরা সব অভিযোগ ‘চক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দিয়ে ‘নিজের লোক’দের সমর্থন করেই চলেন। কোন অভিযোগ কতটা সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু ক্ষমতাবানদের দুরাচার যে গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকেই ক্রমাগত দুর্বল করে তুলছে, সমাজের চোখে প্রশাসনের সর্বস্তরের পরিচালকদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে, সেই সত্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কথা এটাই যে, সমাজের একটি বড় অংশ যেন এই সর্বব্যাপী দুর্নীতিকেই স্বাভাবিক এবং অনিবার্য বলে মেনে নিয়েছে। ক্ষমতাবানের কাছে নীতিনিষ্ঠতার প্রত্যাশাই ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে, দাবি কেবল রকমারি প্রাপ্তিযোগের। কে বলতে পারে, বিচারপতির ক্ষুব্ধ তিরস্কার হয়তো বহু নাগরিকের মনেই আজ আর প্রতিধ্বনি তুলবে না। হয়তো বা দুর্নীতির ভারসাম্যে রচিত হয়েছে নতুন শান্তিকল্যাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gautam Navlakha Supreme Court of India House Arrest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE