পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তীব্র গতিতে নেমে আসছে কাদাজলের সুনামি। চোখের নিমেষে তা গিলে খেল আস্ত একটি জনপদকে। মুহূর্তে তলিয়ে গেল ঘরবাড়ি, হোটেল, গাড়ি, প্রাণভয়ে পালাতে থাকা মানুষ সমেত গোটা গ্রামটাই। ক্ষীরগঙ্গা নদীর উচ্চ অববাহিকায় প্রবল বৃষ্টিতে উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার ধারালী এবং সংলগ্ন অঞ্চলে যে হড়পা বান নেমে এসেছিল গত ৫ অগস্টের দুপুরে, তার ছবি, ভিডিয়ো হাড়হিম করে দেয়। শতাধিক মানুষ এখনও নিখোঁজ। প্রতি বর্ষায় মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বান এবং অজস্র প্রাণহানি ভারতের দেবভূমিটির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ পার্বত্য এলাকায় হড়পা বানের ঘটনা অপ্রত্যাশিত নয়। এর মধ্যে উত্তরকাশীর ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যটিও বিপর্যয়ে খানিক ইন্ধন জোগায়। গঙ্গা এবং যমুনা নদীর উৎসমুখটি অদূরে অবস্থিত। সুউচ্চ শৈলশিরা, নদী, গভীর গিরিখাত ও উপত্যকায় মোড়া উত্তরকাশীর অনেক অংশেই হিমবাহের দেখা মেলে, যেগুলি উষ্ণায়নের কারণে গলতে বসেছে দীর্ঘ দিন ধরেই। এমন ভূপ্রকৃতিতে কয়েক দিনের বৃষ্টি আদর্শ পটভূমি তৈরি করে রেখেছিল কাদাস্রোত, পাথর আর পাহাড় বেয়ে নেমে আসা জলের তোড়কে জনবসতির দিকে ঠেলে দিতে। ধারালী গ্রাম আর সুখী টপ তাই এ যাত্রায় রেহাই পেল না।
কিন্তু শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণকে এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী করা অনুচিত। যে অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি এমন, পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে হামেশাই মেঘফাটা বৃষ্টির দেখা মেলে, সেখানে নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে জনপদ, হোটেল, হোম-স্টে গড়ে ওঠে কী ভাবে? যে অঞ্চল গড়েই উঠেছে দীর্ঘ সময় ধরে কাদার স্তর জমে, সেখানে অতিবৃষ্টি পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে কী দুর্যোগ এবং দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে, প্রশাসনের ধারণা ছিল না? ২০১৩ সালে কেদারনাথের সেই মহাবিপর্যয়ের পরেও উত্তরাখণ্ড সরকার এতখানি নির্লিপ্ত থাকতে পারে কোন যুক্তিতে? না কি ‘বিকশিত ভারত’-এ পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতে এমন বিপর্যয়ই ‘নিউ নর্মাল’, যে কারণে সরকারও আর এ বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিতে নারাজ।
পাহাড় কেটে, খুঁড়ে, ভেঙে, ফাটিয়ে উন্নয়নের যে মহাযজ্ঞ চলছে ভারতব্যাপী, তার ধাক্কায় ভুগছে হিমাচল, সিকিম, দক্ষিণের পাহাড়ি রাজ্যগুলিও। এই বর্ষায় হিমাচলে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। সম্প্রতি বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছে কিন্নর-কৈলাস যাত্রাপথের বিস্তীর্ণ এলাকা। চণ্ডীগড়-মানালি হাইওয়েটি চওড়া করা হয়েছে এমন ভাবে যে, বহু জায়গায় তা বিপাশা নদীর পাড়কে সঙ্কীর্ণতর করে তুলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই বিপাশা বারে বারে হাইওয়ের বিভিন্ন জায়গা ভেঙে তছনছ করে রাস্তা বন্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বৃষ্টিতে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সিকিমের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ি নদীর ছন্দকে ব্যাহত করে তৈরি হয়েছে একের পর এক জলাধার, বাঁধ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। উত্তর সিকিমের বিপর্যয়প্রবণ এলাকাতে নদীর ধার ঘেঁষে কংক্রিটের নির্মাণ নদীর চলার ছন্দটিকেই এলোমেলো করে দিয়েছে। পরিণতি, পর্যটন মানচিত্র থেকে উত্তর সিকিমের প্রায় মুছে যেতে বসা, ক্রমাগত বন্যা, ধসে জীবন-জীবিকায় ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা নেমে আসা। সরকারি অবিমৃশ্যকারিতায় ভারতের পাহাড় এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত। ফেরার পথ আর সম্ভবত খোলা নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)