সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস, বা এসডিজি) অর্জনে আর মাত্র পাঁচ বছর বাকি। কিন্তু সেই লক্ষ্যপূরণে ভারত যে এখনও বেশপিছিয়ে, এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘স্টেট অব স্টেটস’ রিপোর্ট। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর প্রকাশিত এই রিপোর্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্রপুঞ্জ নির্ধারিত সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে গত বছরের ফলাফল অনুযায়ী, ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০৯তম স্থানে। ২০২৩-এর তুলনায় র্যাঙ্কিং-এ তিন ধাপ এগোলেও, বিশ্বের যৌগিক স্কোরের (৬৭ শতাংশ) তুলনায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে ভারত (৬৩.৯ শতাংশ)। বস্তুত, মোট ষোলোটি এসডিজি-র মধ্যে ক্ষুধামুক্তি, লিঙ্গসাম্য, পরিস্রুত জল ও উন্নত নিকাশি-সহ ন’টি সূচকে ভারতের স্কোর বিশ্ব গড়ের তুলনায় কম। এ ভাবে চললে বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার অধিকারী রাষ্ট্রটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে কি না, সে সংশয় প্রকট।
তবে, সেটিই একমাত্র প্রশ্ন নয়। এসডিজি-র ক্ষেত্রে লক্ষ্যগুলি আন্তর্জাতিক স্তরে নির্ধারিত হলেও তা কোন পথে অর্জন করা হবে, এবং কোন সূচকের ভিত্তিতে সেই অগ্রগতি মাপা হবে, তা প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে স্থির করে। ভারতও করেছে। এবং, তাতে একটি বড় সমস্যার সূত্রপাত ঘটেছে। যেমন, এসডিজি-র প্রথম লক্ষ্য দারিদ্র-মুক্তির ক্ষেত্রে ভারত চরম দারিদ্রের পরিমাপ বন্ধ করে দিয়েছে। আগে, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম ক্যালরি বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাপের মাধ্যমে নির্ণয় হত দারিদ্রসীমা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দারিদ্র নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতি বদলে আনুষ্ঠানিক ভাবে বহুস্তরীয় দারিদ্র সূচক (মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স, বা এমপিআই) চালু করেছে ভারত সরকার। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মানে যে সুযোগগুলি পাওয়ার কথা, তা থেকে মানুষ কতখানি বঞ্চিত হচ্ছেন, জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যানের উপরে ভিত্তি করে সেটাই মাপা হয় বহুস্তরীয় দারিদ্র সূচকের মাধ্যমে। গত বছরের গোড়ায় নীতি আয়োগ এক সমীক্ষায় জাতীয় বহুস্তরীয় দারিদ্র সূচকের২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ১৭.৮৯ শতাংশ-বিন্দু হ্রাসের কথা ঘোষণা করলেও, অতিমারি কালে দারিদ্রের উপরে যে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছিল, তা সূচক নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়েছিল কি না, প্রশ্ন উঠছে। ২০১৪-২০২২’এর মধ্যে দেশের মানুষের প্রকৃত আয়ে যে স্থিতাবস্থা আসে এবং ফলস্বরূপ ক্রেতা চাহিদার উপর যে প্রভাব পড়ে, তা দারিদ্র হ্রাসে যে কোনও ভাবেই সাহায্য করেনি— এ কথা অনস্বীকার্য। সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য যেখানে উপযুক্ত পদক্ষেপ করে দারিদ্র বা ক্ষুধামুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে চলা, সেখানে সংখ্যার কেরামতি দিয়ে কি তবে নিজেদের খামতি ঢাকছে কেন্দ্রীয় সরকার? অন্য দিকে, এসডিজি ৬ (পরিস্রুত জল ও নিকাশি)-এ জলের গুণমান মাপার সরাসরি পদ্ধতির অভাব বা এসডিজি ১১ (সুস্থায়ী শহর এবং সম্প্রদায়)-এর ক্ষেত্রে বাতাসের গুণমান ও গণপরিবহণের ক্ষেত্রে কোনও সূচক না রাখা সরকারি অভিপ্রায়ের পরিচায়ক।
সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে রাজ্যগুলির মধ্যেও অসাম্য স্পষ্ট। দারিদ্রশূন্যতার ক্ষেত্রে গুজরাত (৭৫) কর্নাটকের (৭৩) থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, ক্ষুধামুক্তির ক্ষেত্রে সে (৪১) বেশ পিছিয়ে রয়েছে কর্নাটকের (৫৬) থেকে। তেমনই উচ্চ মানের শিক্ষার ক্ষেত্রে তামিলনাড়ু (৭৬) নাগাল্যান্ডের (৪৬) থেকে এগিয়ে থাকলেও লিঙ্গসাম্যের ক্ষেত্রে রয়েছে (নাগাল্যান্ড ৭৪, তামিলনাড়ু ৫৩) পিছিয়ে। ইঙ্গিত স্পষ্ট— মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনও রাজ্য এগিয়ে থাকলেই যে সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যেও এগিয়ে থাকবে, এমনটা নয়। অর্থাৎ, আর্থিক বৃদ্ধি আর সুস্থায়ী উন্নয়ন এক নয়। ফলে, আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে সুস্থায়ী উন্নয়নে গতি আনতে হলে উদ্যোগী হতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’তরফেই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)