পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ— এখন সমগ্র ভারতের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান আলোচিত রাজনৈতিক ‘ন্যারেটিভ’ বা আখ্যান। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের দাবি করছে যে, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কারণে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় জনবিন্যাস বড় আকারে পরিবর্তনশীল, ঠিক যেমন দাবি করা হয়েছিল অসম রাজ্যের ক্ষেত্রে। মনে রাখা ভাল, সীমান্ত পার করে যদিও আসতে পারেন সব ধর্মের মানুষই, সরকারি মতে সকলেই ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন। ‘অনুপ্রবেশ’ ধারণাটির সঙ্গে সিএএ-পরবর্তী ভারত সরকার অত্যন্ত সফল ভাবে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সমীকৃত করে দিতে পেরেছে: অন্য ধর্মের মানুষরা এ দেশে শরণার্থী হিসাবে আলাদা অধিকারলব্ধ, এবং তৎসূত্রে নাগরিকত্বের দাবিদার। কেবল মুসলমানদের চিহ্নিত করার এই পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কাছে অতীব জরুরি, কেননা এ রাজ্যের জনসংখ্যার ন্যূনাধিক ৩০ শতাংশ মুসলমানকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এ বছরে অগস্ট মাসে পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশ নিয়ে তারসপ্তকে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এবং, অতি সম্প্রতি, গত সপ্তাহে তিনি জানান, কেন্দ্রের পরিকল্পনা, তিন ‘ডি’-র মাধ্যমে দেশকে অনুপ্রবেশকারী-মুক্ত করা: ডিটেক্ট (চিহ্নিতকরণ), ডিলিট (ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া), ডিপোর্টেশন (বিতাড়ন)। গতকালের সম্পাদকীয় স্তম্ভের আলোচনার (‘উপলক্ষ ও লক্ষ্য’, ১৬-১০) সঙ্গে মিলিয়ে পড়লেই পরিষ্কার বোঝা যাবে, এক দিকে ভোটার তালিকা সংশোধনের কর্মযজ্ঞ ও অন্য দিকে অনুপ্রবেশ ন্যারেটিভের বাড়বাড়ন্ত কত গভীর রজ্জুতে সন্নিবদ্ধ।
কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান দেখা জরুরি। গত বছর বাংলাদেশে অস্থির পরিস্থিতির সময় থেকে নাকি পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ বেড়েছে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বক্তব্য। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, অগস্ট মাসে অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে রাজ্যসভায় বিরোধীরা জানতে চেয়েছিলেন, গত আড়াই বছরে কত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই জানান, ২০২৩ সালে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েন ১৫৪৭ জন। ২০২৪ সালে ১৬৯৪ জন এবং ২০২৫ সালের অগস্ট পর্যন্ত ৭২৩ জন। অর্থাৎ, বিজেপি সরকারের নিজস্ব হিসাবেই, চলতি বছরে অনুপ্রবেশের গড় হিসাব অনেকটা কম, আগের দু’বছরের তুলনায়। ফলে অনুপ্রবেশ যে ঘটছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও, তার পরিমাণটি জনবিন্যাস পাল্টে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর, এমন তথ্য কেন্দ্রও দিতে পারেনি। উপরন্তু, সংখ্যার সঙ্গে প্রেক্ষিতের বিবেচনাও দরকার। সংসদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের প্রদত্ত হিসাব অনুসারে, এখনও পশ্চিমবঙ্গের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ৫৬৯ কিলোমিটার অঞ্চলে কাঁটাতারের বেড়া নেই। ফলত অনুপ্রবেশের প্রধান দায় বিএসএফ-এর, এবং তৎসূত্রে কেন্দ্রের। সরকারি গাফিলতির কারণে সৃষ্ট একটি সমস্যার মূল্য এখন একটি গোটা সম্প্রদায়কে জীবন দিয়ে মেটাতে হচ্ছে।
কেন্দ্রের এই দায় কিয়দংশে স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন— অনুপ্রবেশকারীরা যে ভাবে ভোটার কার্ড পাচ্ছে এ রাজ্যে, তাতে রাজ্য সরকারের ভূমিকাই প্রধান। তাঁর অভিযোগ যথার্থ। তবে অনুপ্রবেশকারীরা আরও সহজে পাচ্ছে আধার কার্ড। বেআইনি উপায়ে যারা এই সব নথি জোগাড় করে এ দেশে বাস করছে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ আবশ্যিক। তবে অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে তাদের সংখ্যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা অক্ষমার্হ। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই তাদের সীমান্ত পার করে বিতাড়ন বা তাদের উপর অমানবিক অত্যাচারও অমানবিক। সোজা কথা, অনুপ্রবেশ একটি বাস্তব সত্য। কিন্তু এই বাস্তবকে সমগ্র দেশের সামনে অ-সত্য আকারে পেশ করা— বিজেপির সঙ্কীর্ণ, বিদ্বেষভিত্তিক রাজনীতির পথ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)