আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত সাম্প্রতিক কালে নিরামিষ-আমিষ প্রসঙ্গে নানা জায়গায় নানা কথাই বলেছেন, এমনকি এ কথাটিও যে: খাবারের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। শুনে যদি কেউ ভাবেন হিন্দুত্বের মতাদর্শ প্রচার-প্রসারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানটি বোধ হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোঁড়ামি থেকে বেরোচ্ছে, তবে মস্ত ভুল হবে। সরসঙ্ঘচালকের মন্তব্যে প্রতিটি তথাকথিত সোজাসাপটা ‘অশ্বত্থামা হত’-র সঙ্গে একটি সমস্যাবহুল ‘ইতি গজ’ সর্বদাই জুড়ে থাকে; যেমন, খাদ্যের সঙ্গে ধর্ম সম্পর্কহীন, কিন্তু ধর্মীয় উৎসব-ব্রত-উপবাসের সময় মাংস বিক্রি বা আহার অনুচিত। গত সপ্তাহেই এক অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, সরকারি নীতিতে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস তুলে ধরা উচিত, যদিও সঙ্গে এই তথ্যও দিলেন যে হিন্দু সমাজের ৭২ শতাংশ মানুষ মাংস খান।
ভারতীয় সমাজের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, ভারতীয় হিন্দু সমাজও কোনও একশৈলিক অস্তিত্ব নয়। ভারতীয় হিন্দুদের খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র দেখে বিস্ময় জাগতে বাধ্য, যুগ যুগ ধরে তাঁদের ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে আমিষ-নিরামিষের সহাবস্থান কী ভাবে আচরিত ও রক্ষিত হয়ে এসেছে। একই ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশের উত্তরাংশে হয়তো পুজো-উৎসবে নিরামিষ খাচ্ছেন কিন্তু পূর্ব ভারতে মাছ-মাংসের চল, আবার কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বহু ভারতীয় হিন্দু কেবল ব্রত-উপবাসেই নয়, আজীবন নিরামিষ আহারে তৃপ্ত। বিবিধের মাঝে এই মিলন সম্ভব হতে কোনও দিন কোনও সরকারি নীতির প্রয়োজন পড়েনি— ভিন্ন ধর্মের ভারতীয়রা তো বটেই, একই ধর্মের নানা জাতিগোষ্ঠীর ভারতীয়রাও আবহমান কাল ধরে পরস্পরের খাদ্যাভ্যাসের বিভিন্নতাকে সম্মান করেছেন— ধর্মীয় রীতি বা সমাজপ্রথা অক্ষুণ্ণ রেখেই।
ঠিক এই কারণেই আরএসএস-প্রধানের মন্তব্যে ‘সরকারি নীতিতে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস তুলে ধরা’র পরামর্শ আশঙ্কা জাগায়। বিজেপি জমানায় হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার বয়ানে খাদ্যাভ্যাস ক্রমশ এক শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে, নবরাত্রি-সহ নানা হিন্দু উৎসবে মাছ-মাংস খাওয়াই শুধু নয়, তার বিক্রিবাটা, বাণিজ্য ইত্যাদি ঘিরে যে জীবিকা নির্বাহ, সেও পড়ছে শাসকদের কোপে। এই রোষ আর একটি নির্দিষ্ট রাজনীতি বা দলতন্ত্রে সীমিত নেই, সামাজিক পরিসরেও অহরহ মাথা তুলছে— ফ্রিজে গোমাংস থাকার গুজবের জেরে ভিনধর্মী মানুষের প্রাণ চলে যাওয়া, বিজেপি-শাসিত নানা রাজ্যে হিন্দু উৎসব-পূজা-ব্রত-ধর্মীয় যাত্রা ইত্যাদির সময় মাছ-মাংসের দোকান-বাজার জোর করে বন্ধ রাখা, ট্রেনে সহযাত্রীর আমিষ খাওয়া নিয়ে নিরামিষবাদীর আপত্তি ও হুমকি, এই সবই তার উদাহরণমাত্র। আমিষ-নিরামিষের এই দ্বন্দ্বকে শুধু জিইয়ে রেখে নয়, তাকে ঘনীভূত করে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তার কেন্দ্রে নিয়ে আসাই বিজেপির লক্ষ্য— খাদ্যাভ্যাস এক দৃশ্যমান সামাজিক আচরণ বলেই তার মাধ্যমে মানুষে মানুষে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভাজন করা সহজ। বিজেপির এই নিরামিষ-নীতিপুলিশির গোড়াটি বাঁধা আছে আরএসএস-এর মতাদর্শে; তার পুরোধার মুখ থেকে সরকারি নীতিতে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস প্রচার-প্রসারের ‘পরামর্শ’ নির্গত হওয়ার গুরুত্বও সহজেই অনুমেয়। যুগলালিত সামাজিক অভ্যাস পাল্টানো সহজ নয়, কিন্তু মানুষের পাতে সরকার তথা রাষ্ট্রের হাত যাতে এসে না পড়ে— সতর্কতা জরুরি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)