রাজ্যবাসীর মনে একটি প্রশ্ন জাগছে— কোনও নারীনির্যাতনের ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী নীরব থাকলে তা বেশি খারাপ, না কি তিনি কোনও মন্তব্য করলে? সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের ভয়ঙ্কর ঘটনার পর প্রায় দশ দিন অতিক্রান্ত, মুখ্যমন্ত্রী কোনও মন্তব্য করেননি। পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলছে, তিনি মন্তব্য করলেও তা সম্ভবত মানুষকে আশ্বস্ত করত না। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ড, কামদুনি থেকে আরম্ভ করে গত বছরের আর জি কর-কাণ্ড, বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর মন্তব্যগুলি স্মরণ করলে মনে হবে, তাঁর নীরব থাকাই শ্রেয়। অবশ্য, মুখ্যমন্ত্রী কথা না বললেও তাঁর দলের মেজো-সেজো নেতারা বাঙ্ময়। কেউ প্রশ্ন করছেন, আক্রান্ত মেয়েটি একা কলেজে গিয়েছিলেন কেন; কেউ বলছেন, দেশে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, তার মধ্যে রাজ্যে সামান্য একটা ঘটনা ঘটলেই ‘গেল গেল’ রব উঠছে। অন্য এক সাংসদ এই ঘটনার সুযোগে দলেরই আর এক মহিলা সাংসদকে ব্যক্তি-আক্রমণ করছেন। কোনও সভ্য দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই ধরনের কথা বলতে পারেন, এবং ক্রমাগত বলে চলতে পারেন, তা ভাবলেও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। বিজেপি-শাসিত একাধিক রাজ্যে ধর্ষণে অভিযুক্ত নেতাকে গলায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানানোর ঘটনাও গণস্মৃতিতে রয়েছে। দুর্ভাগ্য এই দেশের, যেখানে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধও শেষ অবধি রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারে না।
মুখ্যমন্ত্রীর হিরণ্ময় নীরবতা অবশ্য তাঁর দায় লাঘব করতে পারে না। আগেকার প্রতিটি অভিজ্ঞতা বলছে, ধর্ষণের ঘটনাকেও তিনি দেখেছেন সঙ্কীর্ণ রাজনীতির চশমায়— প্রতিবাদের মধ্যে বিরোধী স্বার্থ খুঁজেছেন, দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। ঘটনায় লাঞ্ছিতা নারী মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে আরও এক বার আহত হয়েছেন মাত্র। দলের কুচো নেতারাও বুঝে নিয়েছেন, এটাই দস্তুর। ধর্ষিতাকেই ঘটনার জন্য দায়ী করতে হয়, ধর্ষকদের দোষ ঢাকতে হয়। তাঁরা বুঝেছেন, শেষ অবধি রাজনীতিই সত্য— এবং, ঘোলা জলে যে যত মাছ ধরতে পারে, তার খাতায় নম্বর ততই বাড়ে। এ বার দল ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট নেতাও দায়সারা ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাতে কি মানসিকতা পাল্টাবে? নেতারা কি বুঝবেন, যা খুশি বলে পার পাওয়া যাবে না? সে সম্ভাবনা তিলমাত্রও নয়। কারণ, যা কিছু করেই, যা কিছু বলেই এই রাজ্যে পার পাওয়া যায়, সে বিশ্বাস প্রশাসনের সর্বময় কর্ত্রীর কথা-আচরণেই পরিপুষ্ট হয়েছে। এই বিশ্বাসটিই তাঁদের রক্ষাকবচ।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সব বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে কথা বলতে হবেই বা কেন? সত্য, প্রশাসন যদি ঠিক ভাবে কাজ করে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গ সে স্বর্গ থেকে বহু যুগ আগেই চ্যুত। এবং, তার চেয়েও বড় কথা, ল কলেজের ঘটনায় অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের মতো লোকেরা যে অকুতোভয়, তা নির্বিকল্প রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণে। তারা বুঝে নিয়েছে, শাসক দলের আশ্রয়ে থাকলে যে কোনও অন্যায় করে পার পাওয়া যায়। ল কলেজ কাণ্ডের পরে স্পষ্ট যে, মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ এত দিন ধরে সত্যই পার পেয়ে এসেছে। এবং বোঝা যাচ্ছে যে, তার পুরনো অন্যায়ের ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই এত দিন মুখ খুলতে সাহস করেননি— এ রাজ্যে মনোজিতের মতো লোকেদের এমনই দাপট। রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতাও সে রকমই— শুধু নারীনির্যাতন নয়, কোনও দাদাগিরি, দুর্নীতি বা অন্যায়েরই শাস্তি এ রাজ্যে হয় না, যদি শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা যায়। এই অন্ধকার থেকে রাজ্যকে উদ্ধার করতে হলে ঘোগের বাসাটি ভাঙতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা ব্যতীত তা অসম্ভব। সে কারণেই, তাঁর কথা বলা জরুরি ছিল। এবং, এত দিন ধরে যেমন কথা বলে এসেছেন, তেমন কথা নয়— এমন কথা, যাতে বোঝা যায় যে, নারীনির্যাতনের মতো অপরাধ করে আর পার পাওয়া যাবে না। কোনও অপরাধ করেই নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)