Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Kolkata Tram

অ-গতি

ট্রামের যাত্রাপথ সঙ্কুচিত করার বিরুদ্ধে হামেশাই বলা হচ্ছে— বিশ্বের বহু উন্নত দেশে পরিবেশবান্ধব ট্রামের আধুনিক সংস্করণ ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।

১৫০ বছরের যাত্রা হয়ত একদিন শেষ হয়ে যাবে।

১৫০ বছরের যাত্রা হয়ত একদিন শেষ হয়ে যাবে। — ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:১৭
Share: Save:

দেড়শো বছর ধরে এক শহরের ঐতিহ্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ কথা নয়। কলকাতার ট্রাম সার্থক ভাবে সেই কাজটি করেছে। এ-যাবৎ কাল এই শহরের বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ওঠানামার সাক্ষী থেকেছে যানটি। সম্প্রতি তার দেড়শো বছরের জন্মদিন পালিত হল। ট্রামের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে কলকাতাবাসীর আবেগ, আন্দোলনের ইতিহাসও। অতঃপর রাজপথের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রুতগতির গণপরিবহণের ধাক্কায় ক্রমশ কোণঠাসা হয়েছে ট্রাম। ঐতিহ্যকে স্বমহিমায় বজায় রাখা, না কি আধুনিক জীবনের গতিশীলতা— এই প্রশ্ন গত এক দশকে বারংবার উঠেছে। সম্প্রতি সার্ধশতবর্ষের আবহে রাজ্য পরিবহণ মন্ত্রক স্পষ্ট করল— চার-পাঁচটির বেশি রুটে ট্রাম চালানো সম্ভব নয়। ট্রাম চলার ঐতিহ্যটিকে সংরক্ষণ করা হবে, কিন্তু গতিশীলতার মূল্যে নয়।

সিদ্ধান্তটি যথার্থ। প্রশ্ন উঠতে পারে, এবং উঠছেও— ক্রমবর্ধমান দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে যখন দূষণহীন গণপরিবহণের প্রয়োজনীয়তা সারা বিশ্বেই অনুভূত হচ্ছে, তখন এই শহরে ট্রামের প্রতি এমন বিমাতৃসুলভ ব্যবহার কেন? নিঃসন্দেহে, বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত পরিবহণের ভূমিকাটি অন্যতম। কিন্তু, বিশেষত কলকাতার ক্ষেত্রে, যেখানে প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা প্রায় সাড়ে চারশো, সেখানে শ্লথগতির ট্রাম পরিবেশের এক অন্য বিপদ ডেকে আনে। ট্রামের কারণে রাস্তার সব গাড়িই গতি হারায়, ফলে দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই ক্ষেত্রে ধীর গতির একটি পরিবহণকে উপযুক্ত জায়গা দিতে হলে অন্য যানবাহনগুলির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ফলে সামগ্রিক ভাবে শহরের গতিশীলতা হ্রাস পাবে। পরিবেশই একমাত্র বিবেচ্য হলে অতীতের বহু দূষণহীন পরিবহণকে ফিরিয়ে আনতে হয়। আধুনিক শহর হিসাবে কলকাতা সেই বিলাসিতা দেখাতে পারবে কি? শুধু পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে সময়ের বিপরীত অভিমুখে হাঁটারও কোনও যুক্তি নেই।

ট্রামের যাত্রাপথ সঙ্কুচিত করার বিরুদ্ধে হামেশাই বলা হচ্ছে— বিশ্বের বহু উন্নত দেশে পরিবেশবান্ধব ট্রামের আধুনিক সংস্করণ ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। সত্য। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, কলকাতার বেশির ভাগ রাস্তা— বিশেষত যে রাস্তাগুলিতে এত দিন ট্রামলাইন পাতা ছিল— আড়েবহরে এমনই সঙ্কীর্ণ যে, সেখানে ট্রাম চললে অন্য গাড়ির জন্য কার্যত আর পথ থাকে না। ফলে, অন্য শহরে যা সম্ভব, কলকাতায় তা করার উপায় নেই। অনেক উন্নত দেশ ট্রামের উপস্থিতি ছাড়াই সফল ভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে চলেছে। সেই পথটিও অনুসরণযোগ্য বইকি। তা ছাড়া, ট্রাম থাকলেই পরিবহণজনিত দূষণ কম হবে— এই ভাবনাটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব। যত ক্ষণ না অন্য যানবাহনগুলিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে সেগুলিকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা হচ্ছে, রাজপথে পুরাতন গাড়ির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম কড়া ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তত দিন কলকাতায় বায়ুদূষণ হ্রাস পাবে না। ট্রাম থাকুক তার ঐতিহ্যের স্থানে। যেখানে তার চলার পথটি বাস, বা অন্য পরিবহণের গতি রোধ করবে না, সেখানে ‘হেরিটেজ’ হিসাবে তার চলার ব্যবস্থা হোক। ঐতিহ্য সংরক্ষণযোগ্য, কিন্তু তা যেন আধুনিকতার পথরোধ না করে, সেটা দেখাও জরুরি বইকি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Tram Kolkata Heritage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE