E-Paper

অসুরক্ষিত

কোনও কর্মী কেবল সেবার আদর্শে প্রণোদিত হয়ে কাজ করতে চাইলে স্বেচ্ছায় তাঁর প্রাপ্য মজুরি না নিতে পারেন। কিন্তু যিনি কোনও নির্দিষ্ট কাজে নিয়মিত দক্ষ শ্রম দিচ্ছেন, নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর পারিশ্রমিকের কাঠামো কেন তৈরি করে দেবে না সরকার?

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:০৯

ভারতের সব শ্রমিক ও কর্মীকে যে সুরক্ষাগুলি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে শ্রম বিধি, নানা সরকারি প্রকল্পে কর্মরত মহিলারা রয়ে গিয়েছেন তার বাইরে। আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা, মিড-ডে মিল কর্মীদের এখনও ‘স্বেচ্ছাসেবক’ তকমা দিয়ে রেখেছে কেন্দ্র। তাঁদের কর্মী বলে স্বীকার করতে সরকার রাজি নয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আদালতও প্রশ্ন করেছে— গুজরাত হাই কোর্ট একটি রায়ে (৩০ অক্টোবর, ২০২৪) সরকারকে বলেছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সহায়িকাদের সরকারি কর্মীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির একটি নীতি তৈরি করতে। আশাকর্মীদেরও দৈনন্দিন কাজের পরিমাণ বিপুল, দায়িত্ব গুরুতর, জবাবদিহির দায় নিয়মিত সরকারি কর্মীদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। গর্ভবতী মা ও শিশুদের সুরক্ষা ও পুষ্টিবিধানে নিয়োজিত আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কাজের মূল্য দেশের কাছে অপরিসীম। তাঁদের ‘স্বেচ্ছাসেবক’ বলে দাগিয়ে দেওয়া বস্তুত ন্যায্য মজুরি ও সুরক্ষা দেওয়ার দায় এড়ানোর কৌশল। মিড-ডে মিল কর্মীদের একটি বড় অংশ দলিত-জনজাতিভুক্ত এবং সংখ্যালঘু মহিলা। এই কাজ এই দরিদ্র মেয়েদের প্রধান জীবিকা। স্কুলের শিশুদের জন্য রান্না-পরিবেশনের গুরুত্বও কম নয়। অথচ, তাঁদের পারিশ্রমিক ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির চেয়েও অনেক কম। উন্নতির আশা নেই, সামাজিক সুরক্ষাও নেই। শ্রমিকের অধিকার এবং নারীর মর্যাদা, দু’টিই নস্যাৎ হচ্ছে। কেবল সরকারি প্রকল্পই নয়, তার বাইরেও নানা ধরনের অসরকারি অথবা বাণিজ্যিক সংস্থা তৃণমূল স্তরের কর্মীদের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হিসাবে দেখিয়ে নিয়োগকর্তার দায় এড়িয়ে যান। বঞ্চনার এই পথ নিরুদ্ধ করবে শ্রম বিধি, এটাই ছিল প্রত্যাশিত।

কোনও কর্মী কেবল সেবার আদর্শে প্রণোদিত হয়ে কাজ করতে চাইলে স্বেচ্ছায় তাঁর প্রাপ্য মজুরি না নিতে পারেন। কিন্তু যিনি কোনও নির্দিষ্ট কাজে নিয়মিত দক্ষ শ্রম দিচ্ছেন, নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর পারিশ্রমিকের কাঠামো কেন তৈরি করে দেবে না সরকার? অন্তত ন্যূনতম বেতন যেন তাঁরা পান, তার ব্যবস্থা বিধিতে রাখা প্রয়োজন ছিল। আক্ষেপ, এই সঙ্কটের প্রতি নজর না দেওয়ায় কর্মীদের, বিশেষত মহিলা-কর্মীদের এক বিপুল অংশ শ্রম বিধির বাইরে থেকে গেলেন। এ বছর শ্রম বিধির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ বার বার উঠেছে যে, তা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। মজুরি বিধি, শিল্প-শ্রম সম্পর্ক বিষয়ক বিধি, সামাজিক সুরক্ষা বিধি এবং পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ সম্পর্কিত বিধি— এই চারটি বিধির মধ্যে শ্রমের প্রধান দিকগুলি অন্তর্ভুক্ত হবে, এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, বহু ধরনের কাজ ও কর্মী বিধির বাইরে রয়ে গিয়েছেন, অথবা কেবল আংশিক স্থান পেয়েছেন। ভারতে অন্তত চার কোটি গৃহশ্রমিক রয়েছেন, প্রধানত মহিলা। তাঁদের মজুরির কাঠামো, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার কোনও জাতীয় রূপরেখা নেই, শ্রম বিধিও সে বিষয়ে নীরব। আর একটি দৃষ্টান্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য কর্মরত খেতমজুর, যাঁদের দশ জনে সাত জন মহিলা। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিধির বাইরে তাঁরা রয়ে যাচ্ছেন। অথচ, চাষে কড়া রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের জন্য নানা ধরনের রোগের শিকার হচ্ছেন খেতমজুররা।

তেমনই, স্বনিযুক্ত কর্মীদের শ্রম বাহিনীর অন্তর্গত বলে দেখাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার, যার ফলে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে ভারতে মেয়েদের শ্রম বাহিনীতে যোগদানের হার অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। অথচ, সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ক বিধি এঁদের ক্ষেত্রে কার্যত নীরব। বিড়ি শ্রমিকদের মতো যে সব মেয়ে কাজ করেন বাড়িতে বসে, কোনও নির্দিষ্ট মালিক-শ্রমিক কাঠামোর বাইরে, তাঁদের ক্ষেত্রেও শ্রম বিধির সুরক্ষাগুলি কী ভাবে কার্যকর হবে, তার কোনও দিশা নেই আইনে। এই বিপুল সংখ্যক কর্মী ও শ্রমিকের যথেষ্ট রোজগার এবং যথাযথ সুরক্ষার পথ দেখাতে পারল না শ্রম বিধি। সেই ব্যর্থতা প্রতিফলিত হবে মানব উন্নয়নের সূচকে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Labour Code Workers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy