পাথর খাদানে ধস নামায় মারা গিয়েছেন ছয় জন শ্রমিক, গুরুতর আহত আরও চার-পাঁচ জন। বীরভূমের নলহাটির এই দুর্ঘটনা বেদনাদায়ক, কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। জেলায় দু’শোরও বেশি অবৈধ পাথর খাদান রয়েছে, তারই একটি বাহাদুরপুর পাথর শিল্পাঞ্চলের এই খাদানটি। মালিক সঞ্জীব ঘোষকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অবৈধ খাদান চিহ্নিত করতে সমীক্ষা শুরু করেছে পুলিশ, ভূমি দফতর এবং জেলা প্রশাসন, এমন আশ্বাসও দিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার। কিন্তু গত এক দশকে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকার নিরিখে এই আশ্বাস বড়ই ফাঁপা শোনায়। ২০১৬ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালত ২১৭টি পাথর খাদানের মধ্যে মাত্র ছ’টিকে বৈধ ঘোষণা করেছিল। তার পরেও কোনও ছাড়পত্র ছাড়াই, পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনেই অবৈধ খাদান এবং ক্রাশার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময়ে ‘বীরভূম জেলা আদিবাসী গাঁওতা’ অবৈধ খাদানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ক্রমে সে আন্দোলন থিতিয়ে গিয়েছে, অবৈধতা রয়েই গিয়েছে। ১১ অগস্ট, ২০২২ বীরভূমের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে পাথর খাদান ও বালি খাদানের বৈধতা নিয়ে জেলা জুড়ে অনুসন্ধান চালায় সিবিআই। বেশ কিছু খাদান বন্ধ হয়ে যায়, কাজ বন্ধ করে হাজারেরও বেশি পাথর ক্রাশার। কিন্তু পাথরশিল্প যেখানে জেলার এক প্রধান জীবিকা, সেখানে খাদান চালানোর রাজনৈতিক চাপ থাকে যথেষ্ট। ফলে অবস্থা যথাপূর্বং। শিল্পের অবৈধতা, অবাধ দূষণ এবং শ্রমিকদের প্রাণহানির পঙ্কিল ছবির তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি।
এই পরিস্থিতির জন্য অর্থলোলুপ নেতা ও বিধি-নস্যাৎকারী খাদান মালিকদের ঘাড়ে দোষ চাপানো সহজ। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, প্রশাসন খাদানগুলিকে বিধিসম্মত করার নিয়মগুলিকে স্বচ্ছ, সহজ ও দ্রুত করতে পেরেছে কি? ২০১৬ সালে বিধি পরিবর্তন করে রাজ্য সরকার খাসজমি ‘ই-টেন্ডার’-এর মাধ্যমে খাদানের জন্য ইজারা দেওয়ার নিয়ম করে। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির জন্য ছাড়পত্র পাওয়ার নীতি নিয়ে এখনও অস্বচ্ছতা রয়েছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিঃসন্দেহে স্বল্প সময়ে অধিক লাভের জন্য বৈধতার শর্তপূরণ, পরিবেশ সুরক্ষার অনুমোদন পাওয়ার প্রক্রিয়াটি এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু এ-ও সত্য যে অতীতে অনেক ব্যবসায়ী দীর্ঘমেয়াদি ইজারা পাওয়ার আবেদন জমা দিয়েছিলেন নিয়মবিধি মেনেই, তাতে লাভ হয়নি। ফলে তিন মাসের স্বল্পমেয়াদি ইজারার পুনর্নবীকরণ করে খাদান চলেছে এক সময়ে। এখন খাদান মালিকদের হাতে যে বৈধতার ছাড়পত্র নেই, তার অন্যতম কারণ সরকারি নিয়মবিধির বারংবার পরিবর্তন, নানা জটিলতা।
পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক শিল্পচিত্রের দিকে তাকালে মনে হয়, অবৈধতার প্রতি এক ধরনের প্রশ্রয় কাজ করে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে। খনি-খাদান, ইটভাটা, নির্মাণ, পরিবহণ— সর্বত্র বিধিভঙ্গ এতই ব্যাপক, এত দৈনন্দিন যে তাকে যেন আর ‘ব্যতিক্রমী’ বলে মনে হয় না। এর রাজনৈতিক সুবিধাটি স্পষ্ট— কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সংযোগ যদি জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায় হয়, তা হলে নিজের গরজেই শিল্প-উদ্যোগীরা সেই প্রভাবশালীদের স্বস্থানে রাখতে চাইবেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর পরিণাম অনুন্নয়ন। বিনিয়োগকারীরা যদি আইনের শাসনের উপর আস্থা রাখতে না পারেন, যদি শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে দোলাচলে থাকেন, তা হলে কেন লগ্নি করবেন? এই অপরিণামদর্শী রাজনীতির ফলে শ্রমজীবী মানুষের জীবন চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। রোজগার করতে হলে তাঁদের কাজ করতেই হবে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রের পরিবেশই শ্রমিক-কর্মীদের নিয়ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খাদান শ্রমিকের হেলমেট নেই, পাথরগুঁড়োর দূষণ থেকে মুক্তি নেই, সামাজিক সুরক্ষা নেই। সিলিকোসিস-এ তিলে তিলে মৃত্যু, না হলে ধসে পাথরচাপা পড়ে মৃত্যু, এই যেন শ্রমিকের বিধিলিপি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)