কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এই দেশ চলেছে, অকস্মাৎ এক-একটি ভয়ঙ্কর ছবিতে তা ধরা পড়ে। এ বছরের বড়দিনের আগে মধ্যপ্রদেশে তেমন একটি ছবি তৈরি হল। জবলপুর শহরের এক চার্চে দৃষ্টিশক্তিরহিত এক বর্ষীয়সী খ্রিস্টানকে রীতিমতো অপমান ও শারীরিক হেনস্থা করলেন সেই শহরের বিজেপি নেত্রী অঞ্জু ভার্গব। জবলপুর এমন কিছু ছোট জায়গা নয়। আক্রমণকারীও এমন কিছু সাধারণ পথচলতি মানুষ নন। ফলে বিষয়টিকে বিক্ষিপ্ত বলা, বা লঘু করে দেখা অসম্ভব। তবু বিজেপির মধ্যপ্রদেশ শাখা কিংবা সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে একটি অনুতাপবাক্যও নিঃসৃত হল না। অথচ সংখ্যালঘু, তায় মহিলা, তায় বয়স্ক, তায় দৃষ্টিহীন— এমন মানুষকে প্রত্যক্ষ ভাবে ধর্মের হেতুতে হেনস্থার ঘটনায় সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারতেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই। বিশেষত যখন এই ঘটনা ঘটার সময়ে মধ্যপ্রদেশে, ছত্তীসগঢ়ে, ওড়িশায়, এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অংশে খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। ধর্মান্তরণের অভিযোগ তুলে খ্রিস্টানবিরোধিতা ও তাঁদের উপর আক্রমণের ধারা অনেক দিনের— ১৯৯৯ সালে ওড়িশার কেওনঝড়ে দুই পুত্র-সহ খ্রিস্টান পাদরি গ্রাহাম স্টেনস-কে জীবন্ত দহন করার ঘটনা আজও দেশবাসী ভোলেননি, নেহাত সেই সময়ের ভিডিয়ো পাওয়া যেত না বলে বিশ্ববাসী তা ‘দেখতে’ পায় না। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে খ্রিস্টানদের প্রাত্যহিক জীবনচর্যার উপর আক্রমণ নিয়মিত ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে— যার পিছনে শাসক সমাজের প্রশ্রয় ও অংশগ্রহণের কথা সর্ববিদিত। সুতরাং, এই বারের বড়দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে প্রশ্ন তোলা যাক: তাঁরা কী চান? তাঁরা কি চান, তাঁদের শাসিত ভারতে অ-হিন্দু সমস্ত রকম সংখ্যালঘু মানুষ এই দেশ থেকে বার হয়ে যান, না কি প্রতি মুহূর্তে মাথা হেঁট করে অপমান সয়ে এই দেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে নিজেদের স্বীকার করে নেন? গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে তাঁরা কি জেনেবুঝেই নতুন রূপ দিচ্ছেন?
প্রশ্নটি আলঙ্কারিক নয়। বাস্তবিক, সংখ্যাগুরুর উগ্রতা দেশকে কোন অতলে নিয়ে যেতে পারে, সীমান্তপারের প্রতিবেশী দেশ সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে। বাংলাদেশের এক হিন্দু শ্রমিককে নির্মম ভাবে হত্যা করা ভিডিয়ো সমস্ত ভারতবাসীকে শিহরিত করেছে, বহির্বিশ্বকেও বুঝিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন কত আতঙ্ককর। ফলে ভারতীয় রাষ্ট্রের নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দায়, এখনই এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানো— ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিষয়ে ভারতের অবস্থানটি ঠিক কী? বাংলাদেশের অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ সমাজের একাংশের অভিযোগ কিন্তু এটাই যে, ভারতের এ নিয়ে কথা বলার কোনও অধিকার নেই, কেননা সংখ্যালঘুর উপর ধারাবাহিক অত্যাচারের নিদর্শন ভারতই পেশ করেছে। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়— ভারত সরকারের, ভারতীয় জনগণের।
এই উগ্রতা যে গত দেড় দশকে দ্রুতগতিতে বেড়েছে, তা মোদী-শাহের অতি বড় সমর্থকরাও অস্বীকার করবেন না, বরং এ নিয়ে গৌরব প্রকাশ করবেন যে কেমন ভাবে সংখ্যালঘুদের ‘টাইট’ দিতে হয়, বর্তমান সরকার তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্মরণীয়, নতুন দেশের উন্মেষকাল থেকে যে সতেরো বছর তিনি ক্ষমতাশীর্ষে ছিলেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার প্রতি সংখ্যাগুরুর বিশেষ দায়িত্বের কথা তিনি নিয়মিত মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই পুরনো ভারতের সরকারি আদর্শটি এই নতুন ভারতে সর্বাংশে পরিত্যাজ্য বলেই কি সংসদের অধিবেশনে সুদীর্ঘ সময় ধরে নেহরু-নিন্দা করতে হয়? ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো সাধারণ রাষ্ট্রীয় কাজকে সংখ্যালঘু-বিতাড়নের যজ্ঞ বলতে হয়?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)