E-Paper

প্রকৃত মনোভাব

শুভেন্দুবাবুরা সম্ভবত মনে করেছেন, ভোটের অনুপাত বাড়াতে হলে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে উগ্রতর করে তোলা প্রয়োজন। সবার উপরে যে-হেতু রাজনীতি সত্য, তাই তাঁরা আর কিছুই ভাবেননি।

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫ ০৫:৪৮

পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা সম্ভবত ভুলে গিয়েছেন যে, শত চেষ্টার পরও এখনও ভারতীয় সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটি মুছে দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেই সংবিধানের শপথ নিয়ে যখন তিনি জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, তখন সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা তাঁর কাছে ‘ঐচ্ছিক’ নয়, বাধ্যতামূলক। অতএব, মনের গহনে তিনি যে বিষই পুষে রাখুন না কেন, তার প্রকাশ্য উদ্গীরণ চলতে পারে না। কাশ্মীর যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি যে কথাগুলি বললেন, কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতিক সচেতন ভাবে তা উচ্চারণ করতে পারেন বলে কিছু দিন আগেও বিশ্বাস হত না। গত এক দশকে ভারত এমন ভাবেই পাল্টে গিয়েছে যে, শুভেন্দুবাবু নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন, মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে বেড়াতে না-যাওয়াই ভাল। গত কয়েক মাসে তিনি, এবং তাঁর দলের অন্য নেতারা কী ভাবে সাম্প্রদায়িক সুর চড়িয়েছেন, রাজ্যবাসীর সে কথা বিলক্ষণ খেয়াল আছে। কেন তাঁরা এমন প্রকট সাম্প্রদায়িকতার পথে হাঁটছেন, তা বোঝাও কঠিন নয়— গত একাধিক নির্বাচনের ফলাফল বলছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির এই একটি বই কার্যকর অস্ত্র নেই। বিশ্লেষকদের মতে, মেরুকরণের মাধ্যমে রাজ্যের ভোটের যে অংশটি দখল করা সম্ভব, বিজেপি ইতিমধ্যেই তা করে ফেলেছে। ফলে, শুভেন্দুবাবুরা সম্ভবত মনে করেছেন, ভোটের অনুপাত বাড়াতে হলে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে উগ্রতর করে তোলা প্রয়োজন। সবার উপরে যে-হেতু রাজনীতি সত্য, তাই তাঁরা আর কিছুই ভাবেননি।

পশ্চিমবঙ্গে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর শমীক ভট্টাচার্য সংখ্যালঘু প্রশ্নে একটি ভিন্নতর অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। নতুন কিছু নয় অবশ্য— ‘ভাল মুসলমান-খারাপ মুসলমান’এর ফারাক রচনার একটি পরিচিত প্রয়াস, বলিউডের সিনেমা যা তাঁর বহু আগে থেকেই করে চলেছে। শুভেন্দুবাবুর বক্তব্যটিকে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত বলার পরও শমীকবাবু বলেছেন যে, বিধানসভার বিরোধী দলনেতার কথায় রাজ্যের মানুষের মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটছে। মানুষ কী ভাবছে, সে প্রশ্ন ভিন্ন— কিন্তু, বিজেপির রাজ্য সভাপতির বক্তব্যে স্পষ্ট যে, দল অন্তত শুভেন্দুবাবুর মতোই ভাবছে; সংখ্যালঘু-প্রশ্নে নমনীয় অবস্থানের প্রহসনটি নিতান্ত স্বল্পায়ু। কেউ বলতে পারেন, এই অবস্থানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের ফারাক রয়েছে। পহেলগাম-হামলার পরে দলের দুই শীর্ষ নেতাই বলেছিলেন, তাঁরা কাশ্মীরে গণতন্ত্র ও স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, এবং সেই ঈর্ষা থেকেই এই হামলা। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় বয়ানে কাশ্মীর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর অংশ। তা হলে, শুভেন্দুবাবু কী ভাবে বঙ্গবাসীকে সেই কাশ্মীরে যেতেই মানা করেন? এবং কী ভাবে দল তাঁর সেই অবস্থানে আপত্তিহীন থাকে? তা হলে কি বিজেপির অভ্যন্তরেও সর্বভারতীয় ও বঙ্গ রাজনীতির দু’টি পৃথক ভাষ্য মান্যতা পাচ্ছে?

বিজেপি নেতাদের অনুমান, পশ্চিমবঙ্গ তাঁদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র হয়ে আছে। কিন্তু, সেই কারণে পশ্চিমবঙ্গের জন্য পৃথক রাজনৈতিক লাইন-এর প্রয়োজন পড়বে না। বরং, শুভেন্দুবাবু যা বলেছেন, সেই বক্তব্যটিকে মোদী-শাহের বক্তব্যের পাশাপাশি রাখলেই কাশ্মীর প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রকৃত অবস্থানটি বেরিয়ে আসে। সেই রাজনীতি কাশ্মীরের দখল চায়, কিন্তু কাশ্মীরের মানুষকে চায় না। ভৌগোলিক ভাবে কাশ্মীর সেই রাজনীতির অখণ্ড ভারতের অংশ, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে সে অঞ্চলের মুসলমান নাগরিকরা ‘অপর’। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রকল্পনায় মুসলমানদের যে স্থান, কাশ্মীর প্রসঙ্গে শুভেন্দুবাবুর বিদ্বেষ তার সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় মেলে। সংবিধান পাল্টাতে না পারলেও জনমানসে তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে নিতান্তই সারবত্তাহীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন বলেই সম্ভবত শুভেন্দুবাবুদের বিশ্বাস। সেই কারণেই, এমন ভয়ঙ্কর মন্তব্য করতে তাঁরা দ্বিধাহীন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Samik Bhattacharya

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy