কেন্দ্রের শ্রম ও নিয়োগ মন্ত্রক সম্প্রতি প্রকাশ করেছে একটি নতুন নীতির খসড়া— ‘শ্রম শক্তি নীতি ২০২৫’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীতিটি বিতর্কের মুখে পড়েছে। কারণ, নীতির ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে তেমন মিল পাওয়া যাচ্ছে না প্রস্তাবিত উপায়গুলির। ২০৪৭ সাল, অর্থাৎ স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে যে লক্ষ্যগুলি নিয়েছে এই নীতি, তার প্রথমটি হল সমস্ত শ্রমিক ও কর্মীর নথিভুক্তি এবং সামাজিক সুরক্ষা। ভারতে ৫০ কোটি শ্রমিকের ৪৫ কোটিই যেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, সেখানে এই লক্ষ্য কী ভাবে পূরণ হবে? নীতি বলছে, অতি-ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) নথিভুক্তি সরল করা হবে, যাতে সেগুলি ক্রমশ আসে সংগঠিত ক্ষেত্রে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু এই বিধান যদি বা কার্যকর হয়, তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কত জন শ্রমিক আসতে পারবেন সামাজিক সুরক্ষার বলয়ে? অসংগঠিত ক্ষেত্রের অন্তত অর্ধেক কর্মী স্বনিযুক্ত, কোনও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মী নন। ফলে এমএসএমই-র নথিভুক্তি বাড়লেও এক বিশাল সংখ্যক শ্রমিক— খেতমজুর, দিনমজুর থেকে হকার, গৃহপরিচারিকা— বাদ পড়ে যাবেন। এঁদের বিষয়ে নীতি নীরব। যদি কেন্দ্রের পাশ-করা চারটি শ্রম বিধির নিরিখে শ্রম শক্তি নীতিকে দেখা যায়, তা হলে প্রশ্ন আরও তীব্র হয়। যেমন, দশ জন বা তার বেশি সংখ্যক কর্মী নিয়োগকারী সংস্থাগুলিকে পেনশন, পিএফ বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে রেখে দিয়েছে সামাজিক সুরক্ষা বিধি (২০২০) এবং পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং কর্ম পরিবেশ বিধি (২০২০)। এই ছোট ছোট সংস্থাই কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রধান নিয়োগকারী। শ্রম বিধির এই সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে নীতি কী করে সার্বিক শ্রমিক নিরাপত্তার লক্ষ্য পূরণ করবে?
কেবল স্ববিরোধ নয়, দ্বিচারিতার অভিযোগও উঠবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। খসড়া নীতির অন্যতম লক্ষ্য, শ্রমের বাজারে মেয়েদের যোগদানের হার বাড়ানো। অথচ, নানা সরকারি প্রকল্পের কয়েক কোটি মহিলা কর্মীকে সরকার কর্মীর স্বীকৃতি দেবে কি না, সে বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করেনি নীতি। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মীরা পূর্ণ সময়ের দায়িত্বপূর্ণ কাজ করেও ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হিসেবে অংসগঠিত ক্ষেত্রেই রয়ে গিয়েছেন। সব ক’টি প্রধান শ্রমিক সংগঠনের সম্মিলিত সুপারিশ সত্ত্বেও প্রকল্প কর্মীদের পূর্ণ সময়ের কর্মীর স্বীকৃতি মেলেনি, ফলে পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুরক্ষাও মেলেনি। তেমনই, গিগ কর্মী, ‘অ্যাপ’-নির্ভর কর্মীরা মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বাইরে রয়ে যাচ্ছে, সেই সত্যটা নীতি স্বীকার করেছে। কিন্তু কী করে এই বিশাল নিয়োগক্ষেত্র নিয়ন্ত্রিত হবে, কী করে শ্রমিকদের প্রাপ্য নিরাপত্তা ও সুবিধা দেওয়া যাবে গিগ কর্মীদের, তার কোনও চিন্তা নেই। শ্রমশক্তি নীতির খসড়াও এ ক্ষেত্রে নীরব। নানা দেশ যখন এ বিষয়ে আইন করছে বা আদালতের নির্দেশ পালন করছে, সেখানে ভারতের আইন ও নীতি বিষয়টি অস্পষ্ট রেখে দিচ্ছে।
এমন নানা অসঙ্গতির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে যে আপত্তি, তা হল শ্রম বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণত কেন্দ্রের অধীনে আনার প্রবণতা। শ্রম যৌথ তালিকার বিষয়, শ্রমিক কল্যাণ ও সুরক্ষার বিষয়ে রাজ্যের নীতি ও সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের সমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু এই খসড়া নীতি কেন্দ্রের তৈরি নকশা চাপিয়ে দিতে চায় রাজ্যগুলির উপর। রাজ্যগুলিতে ‘শ্রম মিশন’ স্থাপন বা জেলায় ‘ডিস্ট্রিক্ট লেবার রিসোর্স সেন্টার’ তৈরি— এ ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো নির্মাণে রাজ্যগুলি আগ্রহী কি না, এই কেন্দ্রগুলির কর্মী, বাজেট কে জোগাবে, তার মীমাংসা না করে নীতির ঘোষণা অর্থহীন। ভারতীয় শ্রম সম্মেলন (আইএলসি)-এর মতো ত্রিপাক্ষিক মঞ্চগুলিকে অকেজো রাখাও নীতি প্রণয়নের পরিপন্থী। আশঙ্কা, জাতীয় শিক্ষা নীতি (২০২০) যে ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে অনেক রাজ্য, শ্রম নীতিরও সেই হাল হতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)