E-Paper

রক্ষাকবচের খোঁজে

প্রস্তাবটির একটি গভীরতর তাৎপর্য রয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সরকার পক্ষের সচেতন সিদ্ধান্তেই সংসদের গুরুত্ব ক্রমে হ্রাস পেয়েছে।

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৪ ০৮:২৯
বা‌ংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণধার মুহাম্মদ ইউনূস।

বা‌ংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণধার মুহাম্মদ ইউনূস।

বা‌ংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণধার মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার সে দেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনে ‘বিজয়ী’ ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা বিধানে তৎপর হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর আবেগাপ্লুত বক্তব্য: শেখ হাসিনার সরকার তথা শাসক দলের অনাচারের কবল থেকে যে ছাত্রসমাজ দেশকে রক্ষা করেছে, তারা বিপন্ন সংখ্যালঘু পরিবারগুলির নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারবে না? সংখ্যালঘুরা কি দেশের অঙ্গ নন? আন্দোলন-সফল ছাত্রছাত্রীরা আপাতত সে দেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত, দৈনন্দিন প্রশাসনের কাজেও সেখানে তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়েছে। বস্তুত, ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা গিয়েছে যে, এক দিকে যখন অশুভ শক্তিগুলি রাজনৈতিক সঙ্কট ও সামাজিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে দুর্বলের উপর চিরাচরিত নিপীড়নে তৎপর, তখন অন্য দিকে, কেবল সুচেতন ছাত্রছাত্রীরাই নন, বিভিন্ন বর্গের বহু সুনাগরিক সেই অনাচারের প্রতিবাদে এবং প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে নবাগত সরকার-প্রধান যে ভাবে সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের সমাজ রক্ষার ডাক দিয়েছেন, সেটা কেবল সদিচ্ছা নয়, বাস্তববোধেরও পরিচয় দেয়।

প্রতিবেশী দেশের এই কঠিন এবং টালমাটাল পরিস্থিতিতে ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিসরেও সদর্থক মনোভাব এবং আচরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কেন্দ্র এবং রাজ্য, উভয় স্তরেই সরকারি প্রতিক্রিয়ায় এ পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রীরা যথাসম্ভব সংযত ভঙ্গিতে অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন। পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজেও এই সংযম বিশেষ ভাবে জরুরি, বিশেষত এই কারণে যে, অতীতের মতোই এ বারেও কার্যত শুরু থেকেই ঘোলা জলে মাছ ধরার দুষ্ট রাজনীতি অতিমাত্রায় তৎপর। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের নেতারা কেউ কেউ সেই তৎপরতায় এতটাই বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন যে, জনশ্রুতি, তাঁদের দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব— সম্ভবত কূটনীতির তাড়নায়— রাশ টানার পরামর্শ বা নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তার পরেও ‘ওপারের সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা’কে মূলধন করে মেরুকরণের রাজনীতি বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন ধরনের প্রচারমাধ্যমেও এই বিপজ্জনক প্রবণতা ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। এই সঙ্কটের মুহূর্তেই সামাজিক শুভবুদ্ধির ভূমিকা বিরাট, রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্যও বিপুল।

সঙ্কটের মধ্যেই নিহিত আছে শুভবুদ্ধির একাধিক প্রেরণা। প্রথমত, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর যে বিপন্নতা, তা এক বৃহত্তর বিপদের অঙ্গ। বহু ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুরা নিছক সংখ্যালঘু বলেই আক্রমণ বা আতঙ্কের শিকার হননি, রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা বা প্রতিহিংসার অন্যতম নিশানা হিসাবেই বিপন্ন হয়েছেন। সংখ্যালঘু পরিচয় নিশ্চয়ই সেই বিপদকে বাড়িয়ে তুলছে, বিপদের মোকাবিলায় তাঁদের সামাজিক দুর্বলতাও অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই, কিন্তু এমন একটি বহুমাত্রিক সমস্যাকে সংখ্যালঘু নিপীড়নের একমাত্রিক ছকে ফেললে ভুল হবে, যে ভুল শেষ বিচারে তাঁদের পক্ষেও ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নজির আরও এক বার দেখিয়ে দেয়, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুর— যে কোনও ধরনের সংখ্যালঘুর— স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষায় সংখ্যাগুরু তথা সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে, বিশেষত গত এক দশকের ভারতে, সংখ্যালঘুর স্বার্থ ক্রমাগত লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে, তাঁদের রক্ষাকবচ কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের উপর প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন নিপীড়নের সীমা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর দেশের ছাত্রছাত্রীদের তথা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের যে আহ্বান জানিয়েছেন, এই দেশের পক্ষেও তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ‘ওপার’-এর সংখ্যালঘুর নতুন বিপন্নতা যদি ‘এপার’-এর সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা রক্ষায় সমাজকে মনোযোগী করতে পারে, দু’পারেরই মঙ্গল হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Muhammad Yunus Bangladesh

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy