E-Paper

আগুন নিয়ে খেলা

দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালের পর থেকে ভারতে জনগণনা হয়নি। ফলে, অঞ্চলভিত্তিক জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটছে কি না, সরাসরি তা জানার উপায় নেই।

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:০২

পর পর দুই রাজ্যে রাজনৈতিক জনসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, অনুপ্রবেশের কারণে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ডেমোগ্র্যাফি বা জনবিন্যাস পাল্টে গিয়েছে। একে এক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করলেন তিনি; এবং জানালেন, এর প্রতিকারে চালু হতে চলেছে জনবিন্যাস মিশন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি বহু স্তরে প্রশ্ন‌যোগ্য। প্রথমত, অনুপ্রবেশের প্রশ্নটি ছেলেখেলার নয়। ফলে, দেশের সর্বোচ্চ আসন থেকে সে বিষয়ে কিছু বলতে হলে সে বক্তব্য যথেষ্ট প্রামাণ্য পরিসংখ্যান দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা নিশ্চিত ভাবে জানা মুশকিল, কিন্তু অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে কত জন ধরা পড়ছে, তা একটি মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহৃত। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসাব অনুসারে, ২০১৬ সালে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় মোট ১,৬০১ জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছিল। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সংখ্যাটি যথাক্রমে ৯০৭ এবং ৮৮৪; ২০১৯ সালে ১,১০৯; ২০২০-তে ৯৫৫। বিএসএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর ২৮ এপ্রিল অবধি অন্তত ৪,৮৯৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করার সময় আটক করা হয়েছিল; ২০২৩ এবং ২০২৪-এ সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ২,৪০৬ জন ও ২,৪২৫ জন; ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ৫৫৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব অনুসারে, ভারতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ২২,৫০০। সংখ্যাগুলি ‘জনবিন্যাস পাল্টে দেওয়া’র পক্ষে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে যদি অনুপ্রবেশকারীর অন্য কোনও সংখ্যা থাকে, তা প্রকাশ করা হোক। নচেৎ প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলি একেবারেই ভিত্তিহীন ক্ষুদ্র রাজনীতির ভাষ্য হিসাবে থেকে যাবে।

দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালের পর থেকে ভারতে জনগণনা হয়নি। ফলে, অঞ্চলভিত্তিক জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটছে কি না, সরাসরি তা জানার উপায় নেই। ২০১১ সালের জনশুমারির পরিসংখ্যানের প্রক্ষেপণ এবং ২০১৯-২১’এর জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে এ কথা বলার কোনও উপায় নেই যে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলির জনবিন্যাস অনুপ্রবেশের কারণে পাল্টাচ্ছে। প্রশ্ন হল, অনুপ্রবেশের কথাটি যদি আদৌ প্রমাণ করা না যায়, তা হলে জনসংখ্যায় কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষের অনুপাত নিয়ে সরকার আদৌ মাথা ঘামাবে কেন? জনবিন্যাস তত্ত্বের গবেষণায় বারে বারেই দেখা গিয়েছে যে, ভারতে সব ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে। বস্তুত, মোট জন্মহার এমন স্তরে নেমে গিয়েছে যে, কয়েক দশকের মধ্যে ভারতে ক্রমশ প্রবীণ নাগরিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবেন। এই পরিস্থিতিতে কোনও অঞ্চলের জনবিন্যাসে কোনও বিশেষ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর অনুপাত বাড়ছে কি না, তা কী ভাবে জানা গেল? রাষ্ট্রীয় মিশন তৈরি করে সেই ‘সমস্যা’র সমাধান করতে চাওয়াও একটি অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ। আশঙ্কা হয়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অসম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে আগুন নিয়ে খেলছেন।

কত অনুপ্রবেশ ঘটছে, তা জানা নেই; অনুুপ্রবেশকারীদের ধর্ম সম্বন্ধে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই— তবু প্রধানমন্ত্রীর মতে, ‘পরিকল্পিত চক্রান্ত’ চলছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেননি বটে, কিন্তু অভিযোগের তির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দিকেই। প্রশ্ন হল, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনী বিএসএফ-এর হাতে। সেই বাহিনী বিরোধী দলের অঙ্গুলি নির্দেশে চলে, প্রধানমন্ত্রী কি এমন ইঙ্গিত করতে চান? না কি, কোনও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তিনি বলতে চান যে, বিরোধী দলগুলি ভোটের স্বার্থে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সমঝোতা করতেও দ্বিধা করে না? প্রধানমন্ত্রী এমন মারাত্মক অভিযোগ করলে তার পক্ষে প্রমাণ দেওয়ার দায়িত্বও তাঁরই। সেই প্রমাণ না দিলে বুঝতে হবে, তাঁদের মেরুকরণের রাজনীতি প্রবেশ করল এক ভয়ঙ্করতর পর্যায়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

infiltration Narendra Modi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy