পশ্চিমবঙ্গে একশো দিনের কাজের প্রকল্প ফের শুরু করার যে নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট, তা বহাল থাকল সুপ্রিম কোর্টেও। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের আবেদন প্রায় তৎক্ষণাৎ খারিজ করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। অতএব এ রাজ্যে ফের প্রকল্প শুরু করায় কোনও আইনি বাধা রইল না। এখন কেন্দ্রকে শ্রমিকদের বকেয়া টাকা চুকিয়ে দিতে হবে; অন্য দিকে, দুর্নীতি মোকাবিলা করার জন্য প্রশাসনিক কৌশল কাজে লাগাতে হবে। রাজ্যেরও কাজ রয়েছে যথেষ্ট। তিন বছর বিরতির পর ফের প্রকল্পের চাকা ঘোরাতে সক্রিয় করতে হবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে— শূন্য পদ পূরণ, সংসদ স্তর থেকে নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা নির্মাণ এবং তা পাশ করা, ভুয়ো কার্ড, প্রকল্পে মজুরদের ভুয়ো তালিকা, ভুয়ো প্রকল্প, এই সব পুরনো বিচ্যুতি শুরু হওয়ার আগেই রুখে দিতে হবে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্য এবং মর্যাদাকে লঙ্ঘন করে যে ভাবে কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী লোক একশো দিনের কাজের প্রকল্পকে ‘কাটমানি’ দোহন করার একটা ব্যবস্থা করে তুলেছিল, তার যথেষ্ট খেসারত দিয়েছে রাজ্য। এখন সতর্ক হতে হবে। সর্বাধিক কাজ তৈরি, সর্বাধিক টাকা খরচ, এই ধরনের রাজনৈতিক লক্ষ্য থেকে সরে এসে জোর দিতে হবে প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাজেট তৈরি এবং হিসাব দাখিলের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের উপর।
রাজ্যবাসীর কাছে একশো দিনের কাজের প্রকল্প পুনরায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু, অতিরিক্ত আশাবাদী না হওয়াই ভাল। কেন্দ্রীয় সরকার একশো দিনের কাজের প্রকল্পের বরাদ্দ ক্রমাগত কমিয়ে চলেছে। ২০২০-২১ সালে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছিল। এর পর ধাপে ধাপে কমে ২০২৪-২৫ সালে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকায়। প্রতি বছরই দেখা যাচ্ছে, গত বছরের প্রকৃত খরচের চেয়ে কম টাকা কেন্দ্র বরাদ্দ করছে পরবর্তী অর্থবর্ষের জন্য— তা-ও টাকার অঙ্কে, ফলে এই বরাদ্দের প্রকৃত মূল্য বুঝতে গেলে তার থেকে মূল্যস্ফীতির হারটি বাদ দিতে হবে। এই বরাদ্দেরও একটা বড় অংশ যাচ্ছে আগের বছরগুলির বকেয়া মেটাতে। স্পষ্টতই, চাহিদার ভিত্তিতে কাজ জোগানোর যে লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে, তা থেকে ক্রমশ পিছিয়ে এসেছে। অতএব প্রকল্প চালু হলেও গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের কাজের চাহিদা কতটা পূরণ করতে পারবে, আগের হারে কাজ পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
আপাতত কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’পক্ষকেই গত তিন বছরের বিবাদ এবং অচলাবস্থাকে ‘অতীত’ বলে স্বীকার করে, নতুন পর্ব শুরু করার উদ্যোগ করতে হবে। হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের মামলার ফলকে নিজের দলের ‘জয়’ বলে দাবি করার ঝোঁক রুখতে হবে। হাই কোর্ট যে রাজ্যের দুর্নীতি স্বীকার করেছে, তাকে ‘জয়’ মনে করছে বিজেপি। আর কাজ ফের শুরু করার নির্দেশকে নিজেদের ‘জয়’ দাবি করছে তৃণমূল। অথচ বিজেপি এবং তৃণমূল, দু’তরফের নেতাদেরই তাকানো দরকার রাজ্যের বিপুল বিপর্যয়ের ছবির দিকে— কেন্দ্র ও রাজ্যের দু’টি সরকার এক সঙ্গে কাজ করতে পারল না বলে দরিদ্র মানুষের দু’হাজার কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের মজুরি মেটানো গেল না তিন বছরে। অগণিত শ্রমজীবী মানুষ কাজের খোঁজে ঘর ছাড়তে বাধ্য হলেন। অতএব মামলার ফল নিয়ে আস্ফালন বন্ধ করতে হবে। একশো দিনের কাজের প্রকল্প চালু হওয়ার পরে গ্রামীণ মজুরি বেড়েছিল, তার ইঙ্গিত মিলেছে নানা সমীক্ষায়। আজ সমীক্ষা করলে যদি ধরা পড়ে যে ঘরের কাছে সম্বৎসর কাজের সুযোগের অভাবে গ্রামীণ মজুরি, বিশেষত মহিলা শ্রমিকদের সব ধরনের কাজের মজুরি কমেছে, শ্রমজীবী পরিবারগুলির ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, এবং এ সবের জেরে অপুষ্টি বেড়েছে, স্কুলছুটের হার বেড়েছে, তবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। এই সার্বিক বিপন্নতার সামনে দাঁড়িয়ে দলীয় সাফল্যের প্রচার নিষ্ঠুর রসিকতার মতো শোনায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)