সম্প্রতি ব্রাজ়িলের রিয়ো ডি জেনিরো-তে অনুষ্ঠিত ব্রিকস-এর সাম্প্রতিক সম্মেলনটি শেষ হল বিশ্বজোড়া এবং আঞ্চলিক বিষয়গুলির উপরে বিস্তৃত বিবৃতি দিয়ে। বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে গাজ়ায় মানবিক সঙ্কটের তীব্র সমালোচনা রইল, পাশাপাশি পারমাণবিক নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে ইরানের উপরে হামলার নিন্দাও শোনা গেল। ভারতের ক্ষেত্রে এই বিবৃতি আরও গুরুত্বপূর্ণ কেননা পহেলগাম সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে গোষ্ঠীর বাকি সদস্যদের নিন্দাবাক্য রইল এতে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বারা চালু করা সাম্প্রতিক শুল্ক যুদ্ধের প্রতি প্রচ্ছন্ন আক্রমণ করতেও ছাড়েনি গোষ্ঠীর সদস্য দেশগুলি।এ দিকে, চিন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি গোষ্ঠীর বাকি সদস্যদের ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর জন্য একটি সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের সুযোগ করে দিল, যাতে জ্বালানি নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব যুক্ত হল সম্মেলনের আলোচনায়।
এখান থেকেই অবশ্য প্রশ্ন। চিন ও রাশিয়ার মতো দেশ যে গোষ্ঠীর সদস্য, এবং অনুপস্থিত সদস্য, তার যৌথ বিবৃতির জোর কতখানি। এমনিতেই পাঁচ থেকে দশ সদস্যে সম্প্রসারিত এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ— একটি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গোষ্ঠী হিসাবে এখনও নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেনি ব্রিকস। সদস্য দেশগুলির মধ্যে কিছু উন্নয়নগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকলেও, এদের যৌথ এবং কৌশলগত পদক্ষেপে বাদ সাধছে অভ্যন্তরীণ নানা বিভেদ। যেমন ভারত-চিন কিংবা ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে অন্তহীন দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা ও অনাস্থা। লক্ষণীয়, সৌদি আরব এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, এখনও পূর্ণ সদস্যপদ গ্রহণ করেনি। এ দিকে, সদস্য রাষ্ট্রগুলির দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাও এর যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। যেমন ভারত ও সৌদি আরবের মতো দেশ যেখানে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, সেখানে পশ্চিমি আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংঘাতের পক্ষে চিন ও রাশিয়া। স্বভাবতই ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার শাসনে শুল্ক যুদ্ধের মুখে পড়ে গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধতা আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প গড়ার বিষয়ে গোষ্ঠীর প্রয়াসকে ‘আমেরিকাবিরোধিতা’ হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর সরাসরি হুমকি— এই পদক্ষেপ করলে ব্রিকস দেশগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক।
অন্য দিকে, নানা সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছাপিয়ে এই সম্মেলন ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে ভারতকে। আগামী বছর সভাপতিত্ব গ্রহণের জন্য নয়াদিল্লি যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সম্প্রসারিত গোষ্ঠীটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য চেষ্টা করা দরকার। পশ্চিম-বিরোধী গোষ্ঠীর পরিবর্তে বাকি বিশ্বের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করা দরকার। লক্ষণীয়, ট্রাম্পযুগে ভারতের ব্রিকসের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রয়োজনীতা আরও বেড়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা ভারতের অগ্রাধিকার হলেও, ওয়াশিংটনের কৌশলগত গতিপথ এবং আমেরিকা-চিন সম্পর্কের অনিশ্চয়তার কারণে আগামী দিনে অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গেও দিল্লির সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি— এই কথাটি বিস্মৃত হলে চলবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)