ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ‘অন্তর্বর্তী সভাপতি’র আসনে সনিয়া গান্ধীর অধিষ্ঠানের তিন বছর পূর্ণ হইতে মাত্র কয় মাস বাকি। এখন, নির্বাচনী বিপর্যয়ের ধারাবাহিক কাহিনির নূতন অধ্যায়ের পরে আহূত দলীয় বৈঠকের সূচনায়, তিনি বলিতেছেন: দল চাহিলে তিনি এবং তাঁহার পরিবার ‘যে কোনও প্রকার ত্যাগ’ স্বীকার করিতে প্রস্তুত; আর দলের নেতারা বলিতেছেন, কখনও তাঁহারা তেমন চাহেন না! ইহাকে নাট্যশালা বলিলে নাট্যশালার অপমান হয়। রবিবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উপস্থিত সদস্যবৃন্দ সমস্বরে জানাইয়াছেন, সনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে তাঁহাদের পূর্ণ আস্থা আছে। অস্যার্থ: পৃথিবী রসাতলে যাইতে পারে, তাঁহারা আঁচল ছাড়িবেন না। নেহরু-গান্ধী পরিবারের অঞ্চলপ্রান্ত ধরিয়া বৈতরণি পার হইবার স্বপ্ন একাদিক্রমে অলীক প্রমাণিত হইতেছে, কিন্তু বিভিন্ন মাপের দলনেতারা এখনও ঊর্ধ্বনেত্রে বলিতেছেন, ওই পরিবারই দলকে একত্রিত রাখিবার যোগসূত্র। তাঁহারা বিলক্ষণ জানেন যে সূত্রটি ইতিমধ্যে রজ্জুতে পরিণত, সেই রজ্জুর অপর প্রান্তে একটি অতিকায় প্রস্তরখণ্ড বাঁধা রহিয়াছে এবং তাহার ভার ক্রমেই বাড়িতেছে। কিন্তু, স্পষ্টতই, তাঁহারা ভয় পাইতেছেন যে পরিবারতন্ত্রের আশ্রয় সরিয়া গেলে দেখিতে দেখিতে দলের বিবিধ গোষ্ঠী ও নেতা-উপনেতার মধ্যে ক্ষমতার রেষারেষি শুরু হইবে এবং তাহার ফলে তাঁহাদের অবশিষ্ট প্রতিপত্তিটুকু হারাইয়া যাইবে। পরিবার তাঁহাদের কায়েমি স্বার্থ ধরিয়া রাখিবার উপায়মাত্র।
এই সমস্যা নূতন নহে, রাজীব গান্ধীর আকস্মিক ও মর্মান্তিক বিদায়ের পরে সীতারাম কেসরীর জমানায় বেহাল কংগ্রেসকে উদ্ধারের জন্যই দলনেতারা সনিয়া গান্ধীকে আঁকড়াইয়া ধরেন। কিন্তু আজ আর তেমন উদ্ধারের কোনও সম্ভাবনা নাই। সনিয়া গান্ধী ও তাঁহার পরিবার এখন কংগ্রেসের পক্ষে একটি বোঝা। এই পরিস্থিতির পিছনে পরিবারের আপন দায় বিপুল। রাহুল গান্ধী সেই দায়ের প্রধান প্রতিমূর্তি। পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসাবে একটি সর্বভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিবার সুযোগ পাইয়া রাহুল গান্ধী আক্ষরিক অর্থেই অতুল কীর্তি স্থাপন করিয়াছেন। একাগ্র চিত্তে এবং নিরন্তর পরিশ্রমে রাজনীতি করিবার প্রাথমিক কাজটুকুও তিনি করিতে চাহেন নাই, থাকিয়া থাকিয়াই অন্তর্হিত হইয়া সমালোচকদের বিদ্রুপ, অনুগামীদের হতাশা এবং জনসাধারণের বিতৃষ্ণা উৎপাদন করিয়াছেন। আবার, উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর ‘অল্প অল্প জলে নামিব কিন্তু বেণি ভিজাইব না’ নীতি সেই একই গোত্রের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়াছে। পরিবার বটে!
কংগ্রেসের এই দুর্দশা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষেও ক্ষতিকর। সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অভিযান প্রতিহত করিতে বিরোধী দলগুলির মধ্যে সমন্বয় এবং সংযোগের মাধ্যম হিসাবে একটি সর্বভারতীয় বহুমত-সহিষ্ণু কেন্দ্রীয় শক্তির মূল্য বারংবার প্রমাণিত হইতেছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন তাহার বড় দৃষ্টান্ত। সেখানেই কংগ্রেসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদীরা তাহা বোঝেন বলিয়াই ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’-এর জন্য তাঁহাদের আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল। অথচ, কংগ্রেসের দুর্মর গতানুগতিকতা সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রধান সহায়ক হইয়া উঠিয়াছে। দলনেতারা এবং তাঁহাদের হৃদিস্থিত ‘হাই কমান্ড’ যদি স্থিতাবস্থার ভজনা ছাড়িয়া দলকে নূতন করিয়া গড়িতে পারেন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কংগ্রেসের শরীরে ও মনে নূতন প্রাণশক্তির সঞ্চার ঘটাইতে পারেন, ভারতীয় রাজনীতির পক্ষে তাহা মঙ্গলজনক হইবে। আর, তাঁহাদের প্রস্তাবিত ‘চিন্তন শিবির’ যদি বালিতে মুখ গুঁজিয়া সর্বনাশ এড়াইবার পরিচিত অভ্যাসের অনুশীলন হয়, তবে তাঁহাদের ঈশ্বরও তাঁহাদের রক্ষা করিতে পারিবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy