E-Paper

উলুখাগড়া

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপি দুর্নীতিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে অনেক দিন ধরেই।

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৩৩
Calcutta High Court

কলকাতা হাই কোর্ট। —ফাইল চিত্র।

কলকাতা হাই কোর্টও প্রশ্ন তুলল, গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে যদি এক হাজার জন প্রকৃত কর্মীর মজুরিও বাকি থাকে, তবে তা মিটিয়ে দেওয়া হবে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রশাসনিকতায় নেই, রয়েছে রাজনীতিতে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার এই সুযোগ কেন্দ্রীয় সরকার দৃশ্যত ছাড়তে নারাজ। ইতিমধ্যেই সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, যে নির্দেশিকার ভিত্তিতে কেন্দ্র এই প্রকল্পের টাকা বন্ধ করেছে, তা জারি করা হয়েছিল টাকা বন্ধ করার বেশ কিছু দিন পরে। ভারতে এখন সবার উপরে রাজনীতি সত্য, ফলে বিরোধী-শাসিত রাজ্যকে প্যাঁচে ফেলতেই যদি কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ থাকবে না। তবে, স্বীকার করতে হবে যে, কদর্যতার নিরিখে সেই রাজনীতি এক নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে। কারণ, একশো দিনের প্রকল্প দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর জন্য। অদক্ষ শ্রমভিত্তিক এই প্রকল্পে যাঁরা যোগ দেন, তাঁদের সামনে উপার্জনের ভিন্ন কোনও পথ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘কঠোরতা’য় তাঁদের বেশ কয়েক মাসের মজুরি বকেয়া থাকার অর্থ, রাষ্ট্র তাঁদের না-খাইয়ে রাখার ব্যবস্থা পাকা করছে। কোনও কল্যাণকামী রাষ্ট্র এই কাজটি করতে পারে কি? কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো বলবে, পশ্চিমবঙ্গের কর্মতালিকায় ভুয়ো নামের ছড়াছড়ি, ফলে মজুরি না-মিললে হাঁড়ি না-চড়ার যুক্তিটি তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সরকারের কথার ঠিক-ভুল বা পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির ব্যাপ্তি ও গভীরতা আপাতত বিবেচ্য নয়। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, যত জনের মজুরি বকেয়া, তাঁদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই ভুয়ো। কিন্তু যে এক শতাংশ প্রকৃত প্রাপক, তাঁদের পাওনা কি এ ভাবে আটকে রাখা চলে? ভারতীয় সংবিধানের মূলগত দর্শন হল, এক জন নিরপরাধ মানুষও যেন ভুল শাস্তি না পান। এই ক্ষেত্রে বিনা বিচারে নিরপরাধ দরিদ্র মানুষকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারকে কে দিল?

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপি দুর্নীতিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে অনেক দিন ধরেই। তার ক্ষেত্র যে রাজ্য সরকারই প্রস্তুত করে রেখেছে, সে কথাও অস্বীকার করা যায় না। আদালতে দাঁড়িয়ে যখন একশো দিনের কাজে ‘ছোটখাটো ভুল’ হওয়ার কথা রাজ্য সরকার স্বীকার করে নেয়, তখন বোঝা সম্ভব যে, বড়সড় গাফিলতি আছে। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে দু’টি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথম কথাটি আদালতই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে— দুর্নীতির অভিযোগ তোলা এক কথা, তার প্রমাণ পেশ করা আর এক। কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম কাজটি যতখানি করেছে, দ্বিতীয়টি তার তিলমাত্র নয়। দ্বিতীয় কথাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ— রাজনীতির অস্ত্রকে প্রশাসনিকতায় ব্যবহার করা চলে না; এবং সেই অস্ত্রে সাধারণ মানুষের ক্ষতিসাধন নৈব নৈব চ। সরকার এবং রাজনৈতিক দল, দুইয়ের মধ্যে ফারাকটি অনপনেয়— রাজ্য এবং কেন্দ্র, উভয় পরিসরেই। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপি যে রাজনৈতিক যুদ্ধ করতে চায়, তাতে যদি কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তা ঘোর অন্যায়। বিজেপি নির্দ্বিধায় সেই অন্যায়টিই করে চলেছে। দুর্নীতি অতি ঘৃণ্য বস্তু। তার বিরুদ্ধে সর্বদা সরব হওয়া প্রয়োজন— সে দুর্নীতি একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রেই হোক বা কোনও বিশেষ শিল্পপতিকে বাড়তি অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক। কিন্তু, প্রশাসনিক স্তরে দুর্নীতির বিরোধিতা করতে হলে তা করতে হবে প্রশাসনিকতার ধর্ম মেনেই। আরও একটি কথা বিজেপি মনে রাখতে পারে— রাজনীতির ঘোলা জল প্রশাসনের জমিতে প্রবেশ করলে যে সোনা ফলে না, পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে কিন্তু তার প্রমাণ মিলেছে। যে কাজ প্রশাসনিক ভাবে অন্যায় এবং রাজনৈতিক ভাবে গোলমেলে, তার প্রতি কেন্দ্রের এমন অদম্য আগ্রহ কেন, কেউ সেই প্রশ্ন করতেই পারেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Calcutta High Court money 100 days work

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy