E-Paper

শৈশবহীন

সবচেয়ে ভয়ের কথা, শৈশব হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় শিশুর অভিভাবকেরাও বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। তাই প্রায়শই এমন নাচ, গান, অভিনয় তাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়, যেগুলি আদৌ তাদের বয়সের পক্ষে মানানসই নয়।

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩ ০৫:২৬
children.

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শিশুশ্রম নিবারণের জন্য প্রতি বছর জুন মাসে আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম-বিরোধী দিবস পালিত হয়। ভারতেও এই বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন আছে। তা সত্ত্বেও কারখানায়, দোকানে গোপনে শিশুশ্রমের ধারাটি অব্যাহত থাকে। আর এক ধরনের শ্রমে অবশ্য শিশুদের ব্যবহার করা হয় প্রকাশ্যেই। বিনোদন দুনিয়ায়। বিনোদনের চাকচিক্যের আড়ালে শিশুশ্রমের মতো ভারী কথা চাপা পড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু অধিকারের প্রশ্নগুলি সেখানেও তোলা সঙ্গত। সম্প্রতি ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস (এনসিপিসিআর) যে নির্দেশিকা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে শিশু ও নাবালক শিল্পীদের দিয়ে দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। শিশুটির নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে প্রযোজনা সংস্থাকে। পোশাক পরিবর্তনের জায়গা আলাদা রাখতে হবে, অন্তত এক জন অভিভাবককে সব সময় সঙ্গে থাকতে হবে, ইত্যাদি। শিশুশিল্পীর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই নির্দেশিকা গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এর পরেও একটি প্রশ্ন অনালোচিত থেকে যায়— শৈশবের অধিকার। শিশু স্বভাবতই আত্মভোলা। নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত নয়। বরং সদ্য চেনা জগৎসংসার নিয়ে তার বিস্ময়ের, জিজ্ঞাসার অন্ত নেই। অথচ, মেধা বিকাশের নামে আজকের বিনোদন জগতে তাদের যে ভাবে ব্যবহার করা হয়, তাতে শৈশব আর বেঁচে থাকে না। প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় সে নিজেকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন হয়ে ওঠে, নিজের উপস্থাপনাকে আরও বেশি আকর্ষক করা নিয়ে মশগুল থাকে। উপস্থাপনা, তার দীর্ঘ অনুশীলন, তারই মাঝে সময় করে পড়া, সাফল্যের উচ্ছ্বাস, নয়তো ব্যর্থতার অবসাদ— এই চক্রের মধ্যেই আবর্তিত হয় তাদের জীবন। নিয়মহারা, হিসাবহীন বয়সের ধর্ম অকালে হারিয়ে যাওয়া তাদের মনোজগতে কেমন ঝড় তোলে, সে বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা হয় না। দাবি করা হয়, সারা দিনের শুটিং-এর ফাঁকেই শিশুশিল্পী পড়ে, খেলেও। কিন্তু শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য শুধু তো এইটুকু যথেষ্ট নয়। তার মনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর নিবিড় সংযোগ প্রয়োজন। সেটা অক্ষুণ্ণ থাকে কি? আইনে শিশুনিগ্রহ রোখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শিশুর সহজ, সরল চরিত্রটিকেই বদলে দেওয়ার উদ্যোগ করা হলে সেটাও কি এক ধরনের নিগ্রহ নয়?

সবচেয়ে ভয়ের কথা, শৈশব হারিয়ে যাওয়ার এই সম্ভাবনায় শিশুর অভিভাবকেরাও বিন্দুমাত্র ভাবিত নন। তাই প্রায়শই এমন নাচ, গান, অভিনয় তাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়, যেগুলি আদৌ তাদের বয়সের পক্ষে মানানসই নয়, সে সবের মানেও তারা বোঝে না। মনে রাখা প্রয়োজন, নিছক হাততালি কুড়োনোর এই আয়োজন এক অর্থে শিশুদের পণ্য বানিয়ে তোলা। শৈশব হারিয়ে শিশু যদি পণ্য হয়ে ওঠে, তবে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু হয় না। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরও যে বিশেষ আপত্তি দেখা যায় না, তার কারণ— সন্তানের কৃতিত্বে মা-বাবার নিজেদের আলোকিত হয়ে ওঠার ইচ্ছাটাই প্রধান হয়ে ওঠে। তাই শিশুর স্কুলে না গিয়ে দশ-বারো ঘণ্টা সেটে সময় কাটানোতেও তাঁদের সায় থাকে। শৈশব সুরক্ষিত করতে শিশুকে বোঝানো প্রয়োজন, প্রতিযোগিতাটাই জীবন নয়, জীবনের অর্থ আরও বৃহৎ। মঞ্চের কৃত্রিমতার বাইরেও এক সুস্থ, স্বাভাবিক পৃথিবী আছে, তার রং, রূপ নিয়ে। প্রশ্ন হল, অভিভাবকরাই অ-বুঝ হলে বোঝাবে কে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Child Rights Child Labour

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy