Advertisement
০১ মে ২০২৪
Illegal Construction

অবৈধ নির্মাণ

যে কোনও অবৈধ কারবার কেবল একটি আইনের লঙ্ঘনে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার চার পাশে একটা দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে, যা আইন, বিধি, প্রচলিত রীতিনীতিকে নস্যাৎ করে দেয়।

Illegal Construction.

এই বেআইনি নির্মাণের কারণে প্রাণ গিয়েছে ওই যুবকের। নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৩ ০৬:০৬
Share: Save:

অবৈধ ভাবে নির্মীয়মাণ একটি বাড়ির উঁচু তলা থেকে দড়ি ছিঁড়ে পড়া লোহার রড বিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক কলেজ-পড়ুয়া তরুণ। তাঁর পরিবার সন্তানের অকালমৃত্যুর জন্য কলকাতা পুরসভাকে দায়ী করেছেন। তাঁরা ভুল করেননি। এমন ঘটনার পরে পুরসভার গৃহ-নির্মাণ দফতরের প্রধান তো বটেই, মেয়রেরও দায় স্বীকার করা, এবং প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করারই কথা। কিন্তু শহরের নাম কলকাতা, দেশের নাম ভারত। এখানে দায়িত্বের সঙ্গে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক ক্ষীণ। বরং উল্টোটাই সত্য— রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সকল দায়মুক্তির পাসপোর্ট হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত এ দেশের নেতারা। কখনওসখনও জনসংযোগের খাতিরে প্রশাসনিক সক্রিয়তার পরিচয় দিতে যান কর্তারা। তখন নানা করুণ কৌতুকের অভিনয় হয়। যেমন, মেয়র ফিরহাদ হাকিম তাঁর ‘টক টু মেয়র’ প্রকল্পে অবৈধ নির্মাণের অভিযোগ পেয়ে গত বছর পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের কর্তাদের এবং পুলিশকে দায়ী করেন। যদিও পুরপ্রধান হিসাবে বিল্ডিং বিভাগও তাঁরই অধীনে, অতএব নিষ্ক্রিয়তার দায়ও তাঁর উপর বর্তায়। যে কোনও দুর্নীতি, অপদার্থতার দায় অধস্তন আধিকারিকদের উপর চাপিয়ে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা এ রাজ্যের নেতাদের একটি পরিচিত কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে পরিস্থিতি শুধরোয় না, কলকাতার কিছু ওয়র্ডে অবৈধ নির্মাণ প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। মৃত যুবকের বাড়ি যেখানে ছিল, সেই ৯ নম্বর বরোর অন্তর্গত একবালপুর, ওয়াটগঞ্জ এলাকায় অবৈধ নির্মাণের অভিযোগ ভূরি ভূরি। অতএব কলেজ-পড়ুয়া জাকির আলির মৃত্যুকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া কঠিন। অবৈধ নির্মাণের চক্র যাঁরা অপ্রতিহত রেখেছেন, এ মৃত্যুর দায় তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না।

যে কোনও অবৈধ কারবার কেবল একটি আইনের লঙ্ঘনে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার চার পাশে একটা দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে, যা আইন, বিধি, প্রচলিত রীতিনীতিকে নস্যাৎ করে দেয়। চোলাইয়ের ঠেক মেয়েদের হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অবৈধ ইট ভাটা দাসশ্রমের ঘাঁটি হয়ে ওঠে। অবৈধ নির্মাণও এর ব্যতিক্রম নয়। কেবল যে নিয়ম ভেঙে বাড়ির অতিরিক্ত তলা তৈরি হয়, বা পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরি হয়, তা-ই নয়। নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটিই বিধির ধার ধারে না। যে ভাবে দড়িতে বেঁধে লোহার রড তোলা হচ্ছিল ওয়াটগঞ্জের ওই বাড়িটিতে, তা নিরাপত্তাবিধি নস্যাৎ করার একটি মারাত্মক দৃষ্টান্ত। এর খেসারত দিতে হয় নির্মাণ-শ্রমিকদেরও।

একই সঙ্গে পথচারী এবং বাইক আরোহী, গাড়ি আরোহীদের বিপন্নতাও বাড়ে। রাস্তার মাঝখানে ইমারতি দ্রব্য ফেলে রাখা কলকাতা তথা সারা রাজ্যেই অতি পরিচিত দৃশ্য। অতি সঙ্কীর্ণ পথেরও আধখানা জুড়ে বালি, পাথরের স্তূপ যাতায়াতকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং মন্থর করে তোলে, দুর্ঘটনা ঘটায়। বৈধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও অবৈধ ভাবে ফুটপাত ও রাস্তার ব্যবহার নিয়ম হয়ে উঠেছে। এই সব বিধিভঙ্গের মূল যে প্রোথিত রয়েছে অসাধু আঁতাঁতে, তা কারও অজানা নয়। এক দিকে ‘প্রোমোটিং’ অন্য দিকে ‘সিন্ডিকেট’ ব্যবসা গড়ে উঠেছে, দু’টিই চলছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের ছত্রছায়ায়। নির্মাণকে ঘিরে বিধিভঙ্গ যত প্রকট, ততই প্রতিকারহীন— নাগরিকের মৃত্যুও এই দুষ্টচক্রকে আঘাত করতে পারে না। আইনের শাসনের ধারণাকেই প্রহসন করে তুলছে অবৈধ নির্মাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Illegal Construction Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE