Advertisement
০২ মে ২০২৪
Journalists

সংবাদের কারাগার

কাশ্মীরের পরিস্থিতি গুরুতর। কিন্তু কেবল কাশ্মীরের জন্যই উদ্বেগ নয়। সাংবাদিকরা আশঙ্কিত যে, সারা দেশের সাংবাদিকদের উপরেই ‘কাশ্মীর মডেল’ প্রয়োগ করতে উদ্যত নরেন্দ্র মোদী সরকার।

An image of Journalist

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:২২
Share: Save:

সরকারের সমালোচনার জন্য সাংবাদিকদের জেলবন্দি করে রাখা চলে না, মনে করাল জম্মু ও কাশ্মীর হাই কোর্ট। কাশ্মীরের দুই সাংবাদিকের জামিন পাওয়ার খবর যতটা স্বস্তি আনে, ততটাই অস্বস্তি জাগায় এই প্রশ্ন— কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যম মুক্তি পাবে কবে? জামিনপ্রাপ্তদের এক জন, সাজাদ আহমেদ ডর, নিজের সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন, যেখানে এক নিহত সন্ত্রাসবাদীর পরিবারকে ভারত-বিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিল। সেই ‘অপরাধ’-এ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ, এবং জনসুরক্ষা আইন (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট) প্রয়োগ করে তাঁকে জেলবন্দি রাখে। আদালত ডরকে বন্দি রাখার সিদ্ধান্ত খারিজ করে বলে, তাঁর কোন কাজে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বরং গ্রেফতারকারী কর্তৃপক্ষই স্বীকার করেছে যে, ডর সাংবাদিক— তিনি সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর, সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করছেন। নিজের এলাকায় যা কিছু ঘটছে, সে সব নিয়ে সংবাদ করা তাঁর কাজ। তার মধ্যে পড়ে সেনাবাহিনীর কার্যকলাপও। সরকারি নীতির সমালোচনা, অথবা প্রশাসনের কাজে, বা কাজের ভ্রান্তি নিয়ে সমালোচনা যাঁরা করেন, তাঁদের গ্রেফতার করার অর্থ অপরাধ প্রতিরোধের জন্য তৈরি আইনের অপব্যবহার। পাশাপাশি, ‘কাশ্মীর ওয়ালা’ ওয়েবসাইটের সম্পাদক ফাহাদ শাহকে যে সংবাদ পরিবেশনের জন্য ইউএপিএ-তে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল এগারো বছর আগে। শাহ মুক্ত থাকলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কী ভাবে ব্যাহত হবে, তদন্তকারী সংস্থা তার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি আদালতকে।

কাশ্মীরের বহু সাংবাদিক রাজ্য বা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, বহু সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাশ্মীরের সাংবাদিকরা দীর্ঘ দিন সাংবাদিকের প্রতি, এবং বাক্‌স্বাধীনতার প্রতি, পুলিশের অকারণ নির্যাতনের যে অভিযোগ তুলে চলেছেন, হাই কোর্টের বক্তব্যে তারই সমর্থন। সেই অভিযোগ এই যে, পুলিশ বস্তুত সরকারের ইশারায় কঠোর নানা ধারায় সমালোচকদের জেলে ভরছে। আদালত জামিন দেওয়া মাত্র জামিন অযোগ্য জনসুরক্ষা আইন আরোপ করে ফের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমন ঘটেছে অন্তত তিন জন সাংবাদিকের ক্ষেত্রে। জনসুরক্ষা আইনে দু’বছর পর্যন্ত বিচার না করেও বন্দি রাখা যায়। আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করার কাজটিকে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা নিয়েও সংশয় থাকে। যেমন, সাজাদ আহমেদ ডরের পরিবেশিত কোন সংবাদটি ভ্রান্ত, কোনটি শান্তিভঙ্গের কারণ হয়েছে, তা তারা স্পষ্ট করতে পারেনি হাই কোর্টের কাছে। বিচারপতিরা বলেছেন যে, সত্য এবং তথ্যনির্ভর সংবাদ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষকে প্ররোচিত করতে পারে, এমন ধরে নেওয়া চলে না। সরকারের বিরূপ সমালোচনা করার জন্য সাংবাদিককে গ্রেফতার করা যায় না।

কাশ্মীরের পরিস্থিতি গুরুতর। কিন্তু কেবল কাশ্মীরের জন্যই উদ্বেগ নয়। সাংবাদিকরা আশঙ্কিত যে, সারা দেশের সাংবাদিকদের উপরেই ‘কাশ্মীর মডেল’ প্রয়োগ করতে উদ্যত নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আদালতের এই কথাগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেও দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, সাম্প্রদায়িক প্রভৃতি অভিযোগের মুখে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। যথেচ্ছ আইনের ধারা আরোপ করে সাংবাদিকদের বিচারাধীন বন্দি করা হচ্ছে, যাতে সব সাংবাদিকের উপরেই চাপ তৈরি হয়। সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান নেমে চলেছে হুহু করে। ২০২৩ সালের বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান দাঁড়িয়েছে ১৬১-তে। শ্রীলঙ্কা (১৩৫) ও পাকিস্তান (১৫০) ভারতের উপরে: এ তথ্যের সামনেও মোদী সরকার অবাধ স্বাধীনতাভঙ্গে সক্রিয়। প্রশ্নহীন আনুগত্যই এখন মুক্ত থাকার শর্ত। এই দেশজোড়া কারাগার থেকে মুক্তি মিলবে কী করে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE