E-Paper

শ্রমিকের কল্যাণ

হরিয়ানার নুহ জেলায় সাম্প্রদায়িক হিংসার মুখে পড়ে কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরতে বাধ্য হলেন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা।

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০২
migrant workers

—প্রতীকী ছবি।

গঠন হওয়ার পরেই পরীক্ষার মুখে পড়ল পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ। হরিয়ানার নুহ জেলায় সাম্প্রদায়িক হিংসার মুখে পড়ে কাজ ছেড়ে ঘরে ফিরতে বাধ্য হলেন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা। ধর্ম বা ভাষার ভিন্নতার জন্য বাঙালি শ্রমিকের উপর আক্রমণকে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বরদাস্ত করবে না, সে বিষয়ে শক্তিশালী বার্তা সারা ভারতের সামনে তুলে ধরার এই ছিল সুযোগ। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে, এবং নিয়োগকারীদের থেকে বকেয়া মজুরি আদায় করতে শ্রমিকদের সহায়তা করতে পারত পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ। যে বিতাড়িত শ্রমিকরা ফের হরিয়ানায় কাজে ফিরতে ইচ্ছুক, তাঁদের সুরক্ষার জন্য পর্ষদ কর্তারা হরিয়ানা সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ করতে পারতেন। তাতে আশ্বস্ত হতেন শ্রমিকেরা। আক্ষেপ, কার্যক্ষেত্রে সে সব শোনা গেল না। বদলে শোনা গেল চর্বিতচর্বণ— পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত কিছু সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাবেন বিতাড়িত মজুরেরা, এবং রাজ্যেই তাঁদের বিকল্প কাজ দেওয়ার চেষ্টা হবে, সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পর্ষদ কর্তারা। এত দিন রাজ্য সরকারের মন্ত্রী-আধিকারিকরা যে বয়ানটি প্রচার করে গিয়েছেন, এখন তারই প্রচার করছে পর্ষদ। বয়ানটি গোলমেলে। ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া নিষ্প্রয়োজন, কারণ রাজ্য সরকার এ রাজ্যে প্রচুর কাজ তৈরি করেছে, এমন চিন্তায় স্বচ্ছতার অভাব। এ রাজ্যে যে যথেষ্ট কাজ, যথেষ্ট রোজগারের সুযোগ তৈরি হয়নি, সে কথা স্বীকার করাই ভাল। রাজ্য সরকার দু’লক্ষ কাজ তৈরির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে সাংবাদিকদের। প্রশ্ন হল, রাজ্য সরকারের আন্দাজ অনুসারেই যখন এ রাজ্যের অন্তত আটত্রিশ লক্ষ শ্রমিক বাইরে কাজ খুঁজতে যান, তখন দু’লক্ষ কাজের হিসাব দিয়ে লাভ কী?

পর্ষদের কর্তাদের ঘোষণা, পর্ষদের মাধ্যমে ভিন রাজ্যগামী শ্রমিকের নথিভুক্তি ও প্রশিক্ষণ হবে, এবং রাজ্যেই কর্মনিযুক্তির চেষ্টা হবে। প্রশ্ন উঠবে, কেন? শিল্পের প্রয়োজনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নানা সময়ে, নানা ধরনের কাজ সৃষ্টি হয়। সেই অনুসারে শ্রমিকের প্রয়োজনেও সব সময়েই ওঠা-পড়া চলতে থাকে। পরিযায়ী শ্রমিকরা শিল্পের সেই চাহিদা মেটান, পরিবর্তে লাভ করেন বাড়তি মজুরি, অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতাও। ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া তাই শ্রমিক-স্বার্থ পরিপন্থী নয়। সবল অর্থনীতির জন্যও তা প্রয়োজন। সর্বোপরি, ভারতের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে যে কোনও রাজ্যে কাজের অধিকার দিয়েছে। সেই মৌলিক অধিকারের সুরক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাকে সরকারি প্রকল্পের বাহুল্য দিয়ে ঢাকা যায় না।

বাস্তব এই যে, এ রাজ্যের চাইতে পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে কাজের জোগান বেশি, এবং পারিশ্রমিকের হারও বেশি। এই কারণেই কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, দিল্লি প্রভৃতি রাজ্যে কাজ করছেন লক্ষ লক্ষ বাঙালি শ্রমিক। সব কর্মক্ষম মানুষের জন্য যথেষ্ট কাজ, যথেষ্ট রোজগার জোগান দিতে পারবে, পশ্চিমবঙ্গে তেমন শ্রমনিবিড় শিল্প কোথায়? সরকারি অনুদানের খুদকুঁড়ো কুড়িয়ে খেতমজুর, দিনমজুরের সংসার চলে না। সরকারি প্রকল্পের কাজ তাঁদেরকে দারিদ্রের ফাঁদে পতন থেকে রক্ষা করতে পারে মাত্র। কর্মনিযুক্তির সুযোগ রাজ্য সরকার বাড়াতেই পারে। তা বলে শ্রমিক-নিষ্ক্রমণ কমানো, বা পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত অন্য রাজ্যের শ্রমিকদের জায়গায় বাঙালি শ্রমিকের নিয়োগ— এগুলি পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের লক্ষ্য হয় কোন যুক্তিতে? রাজ্যের যে মজুররা ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন, এবং অন্য রাজ্যের যে মজুররা এ রাজ্যে আসছেন, তাঁদের অধিকারের সুরক্ষা এবং তাঁদের পরিবারের সহায়তাই শ্রম দফতর, তথা পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের প্রধান কর্তব্য। তার জায়গায় বিকল্প কাজ সরবরাহ, বা মৃত শ্রমিকের পরিবারকে অর্থ সহায়তা— এ সব কর্মসূচি শ্রমিক কল্যাণের কেন্দ্রে থাকতে পারে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

West Bengal Haryana

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy