Advertisement
E-Paper

শিরোধার্য

ভারত কেবল সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নহে, প্রতিষ্ঠার কালেই এই প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণের কথা বলা হইয়াছিল।

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:০৭

গোহরণ ও জবাইয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনের আবেদন খারিজ করিতে গিয়া যে সকল যুক্তি সাজাইয়াছেন ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব, তাহাতে বিস্তর বিতর্কের রসদ মজুত হইয়াছে। গরুর অলৌকিক মাহাত্ম্যবর্ণন শেষে তিনি আফগানিস্তানে তালিবানি দখলের প্রসঙ্গ তুলিয়াছেন। আদালতের রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও এমন অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত মন্তব্য শুনিলে বিস্ময় প্রকাশ করিতেই হয়। ‌উত্তরপ্রদেশের গো-জবাইয়ের সহিত প্রতিবেশী দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের যোগ থাকিতে পারে কি? না থাকিলে, অকস্মাৎ তাহার উল্লেখ কেন? এমন লঘু মন্তব্য কি আদালতের নিকট কাঙ্ক্ষিত? এহ বাহ্য— ইতিমধ্যেই তালিবানের ঘৃণার রাজনীতির জুজু দেখাইয়া ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিস্তর জলঘোলা করিতেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিসমূহ। উহাতেই জল-হাওয়া পাইতেছে স্বদেশীয় ঘৃণার রাজনীতি— তালিবানের অপর পিঠ। আদালতের মন্তব্যে সেই সুরেরই অনুরণন শোনা গেল কি না, কেহ এই প্রশ্ন করিতেই পারেন।

তবে, বিচারপতি যখন এই সকল যুক্তির ভিত্তিতে গো-রক্ষাকে হিন্দুদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করিবার কথা বলেন, তখন ‘মৌলিক অধিকার’ শব্দবন্ধের সংজ্ঞাটিই পুনরায় পড়িবার প্রয়োজন হয়। যাহা কাড়িয়া লইলে কাহারও মনুষ্যত্ব হরণ করা যায়, তাহাই মৌলিক অধিকার। ভারতে সংবিধান-স্বীকৃত ছয়টি মৌলিক অধিকারের স্বরূপ দেখিলেই বুঝা যাইবে যে, উহার অনস্তিত্বে নাগরিকের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হয়। কোন যুক্তিতে গো-রক্ষা সেই তালিকাভুক্ত হইবে? ভারতীয় সমাজে আইনের গণ্ডির বাহিরেও সামাজিক ওজনের দাবিতে কোনও অধিকার স্বীকৃতি পাইতে পারে। কিন্তু গো-রক্ষার ন্যায় যে সকল দাবি শুধুমাত্র কিছু নাগরিকের ভাবাবেগের উপর ক্রিয়াশীল, তাহাকে মান্যতা দেওয়া যায় কি? ভাবাবেগ বস্তুটি ব্যক্তিসাপেক্ষ, তাহা আইনের পরিসরে আনিতে হইলে শেষাবধি কূল পাওয়া মুশকিল হইবে। বিপ্রতীপে ইহা সত্য, গো-রক্ষা বহু নাগরিকের অধিকার হরণ করিয়াছে। গো-মাংস নিষিদ্ধ করিবার অর্থ, এক শ্রেণির নাগরিককে খাদ্যের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা। সুতরাং, গো-ভক্ষণ হত্যার ‌অধিকার এবং গো-রক্ষা বাঁচাইবার অধিকার কি না, ভাবিয়া দেখা বাঞ্ছনীয়। জীবরক্ষা করিতে গিয়া মানুষের জীবনের অধিকার কাড়িয়া লওয়া যায় না।

প্রশ্ন উঠিবে ‘হিন্দু’ শব্দের উল্লেখ লইয়াও। ভারত কেবল সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নহে, প্রতিষ্ঠার কালেই এই প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণের কথা বলা হইয়াছিল। সংবিধান রচনার কালে গণপরিষদের কতিপয় সদস্য গো-রক্ষাকে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করিবার কথা বলিলে প্রস্তাবটি নাকচ হইয়া যায়। ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী। সেইখানে ধর্ম ও রাষ্ট্রক্ষমতাকে জড়াইয়া ফেলা শুধু অস্বীকৃত নহে, অননুমোদিত। চিন্তা ও কর্মে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকিতে না পারিলে তাহা সংবিধানের অবমাননা। এবং, রাষ্ট্রের গাঠনিক উপকরণ হিসাবে রাজনৈতিক দলগুলির যেমন তাহা ধারণ করা জরুরি, রাষ্ট্রের অপর ভিত্তিপ্রস্তরগুলির পক্ষেও সর্বদা তাহা শিরোধার্য করাই কাম্য।

Cow Slaughter Uttar Pradesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy