Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Amar Jawan Jyoti

অমরত্বের প্রত্যাশা

নেতারা মনে রাখেন না, ইতিহাসকে ছিঁড়িয়া ভাঙিয়া বিনষ্ট করিয়া যাহা তৈরি হয়, সেই ‘মূঢ়সম রাজদণ্ড’ সাধারণত চিরস্থায়ী হয় না।

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২২ ০৪:৩৭
Share: Save:

এই বৎসর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ভারতের একটি দেউটি নিবিয়া গেল। ইন্ডিয়া গেটের পার্শ্বস্থিত অমর জওয়ান জ্যোতি নামে অনির্বাণ শিখাটি, যাহা পঞ্চাশ বৎসরকাল যাবৎ জ্বলিতেছিল, তাহা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে নির্বাপিত হইল। অবশ্য তাহা চিরতরে নিবে নাই, নবপ্রজ্বলিত জাতীয় যুদ্ধ স্মারকের শিখার সহিত মিশিয়াছে— অন্তত ইহাই সরকারের ব্যাখ্যা। যাহা হউক, পুরাতন শিখাটি যে আর রহিল না, ইহাই আকাঁড়া বাস্তব। সাদা চোখে ইহার কারণ বোঝা দুষ্কর। শহিদ সেনার সম্মাননার্থে রাজপথে যখন একটি শিখা জ্বলিতেছিল, তখন আর একটিকে উপস্থিত করিবার অর্থ কী? এবং, দ্বিতীয় শিখাটি জ্বালাইয়া প্রথমটিকে তাহার সহিত মিশাইয়া দিবার ন্যায় জটিল প্রক্রিয়াই বা কেন? অতএব, ইহার তির্যক অর্থটি বুঝিতে হয়— পুরাতনটি এক্ষণে নিষ্প্রয়োজন, অতএব অবাঞ্ছিত। ইহা যদি রাজনীতির হিসাব হয়, তবে উহাপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক কিছু নাই। যদি না-ও হয়, তৎসত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় আবেগ সম্পর্কে সরকারের এতাদৃশ উদাসীনতা প্রশ্ন জাগাইবে। নূতন স্মারক নির্মাণ স্বাগত, কিন্তু যে পুরাতনের সহিত দীর্ঘ দিনের আবেগ জড়িত, তাহাকে রক্ষা করাও দায়িত্ববিশেষ। সরকারের দায়িত্ব।

বিষয়টি হয়তো একক হিসাবে ছোট। কিন্তু এই একই ধরনের কাজ যখন অন্যত্রও হইতে দেখা যায়, বোঝা যায় ইহার পিছনে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা রহিয়াছে। এই আমলেই জালিয়ানওয়ালা বাগ তাহার ঐতিহাসিক রূপ পাল্টাইয়া পুনঃসজ্জিত হইয়াছে, কাশী বিশ্বনাথের গলি নবরূপ পাইয়াছে, দিল্লির অবয়ব দ্রুত বদলাইতেছে— এবং, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরাতন সম্পূর্ণ ভাসিয়া গিয়াছে। জালিয়ানওয়ালা বাগের যে সঙ্কীর্ণ গলিপথ শীতলমস্তিষ্ক হত্যালীলার ঔপনিবেশিক স্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছিল, তাহার পুনর্নির্মাণ কলঙ্কিত ইতিহাসটিকে বহুলাংশে মুছিয়া দিলে তাহার ঐতিহ্যটিই পাল্টাইয়া যাইবার কথা। শহিদমূর্তি স্থাপন সাধু প্রয়াস, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র অগ্রাহ্য করিয়া নহে। আবার বিশ্বনাথ মন্দিরচত্বর পাঁচ লক্ষ বর্গফুটের সুবৃহৎ পরিসর পাইলেও, বিলুপ্ত হইয়াছে প্রাচীন শহরের অভিজ্ঞান: কাশীর সুবিখ্যাত গলি। দিল্লি নবরূপায়ণে যে জাতীয় অভিলেখাগার বা ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় কলা কেন্দ্র ভাঙা পড়িবে, তাহা ইতিমধ্যেই ঘোষিত। অমর জওয়ান জ্যোতির নির্বাপণও এই সকল কর্মকাণ্ডের সহিত মিলাইয়া দেখা যাইতে পারে। সকল জমানাই আপনাপন ছন্দে নূতন নির্মাণ করিয়া থাকে। কিন্তু বর্তমান সরকার যেন ব্রত লইয়াছে, পুরাতন চিহ্নসকল না মুছিয়া সে শান্ত হইবে না।

এই সিদ্ধান্তসমূহের ভিত্তি যে কেবল প্রশাসনিক দায় হইতে পারে না, তাহা যে নির্দিষ্ট রাজনীতিসঞ্জাত, বুঝিতে অসুবিধা নাই। মোদী জমানার পূর্বে যাহা ঘটিয়াছে, তাহার সকলকেই হয় ভ্রান্ত বা অনস্তিত্বশীল করিয়া দিবার এক উদগ্র জেদ ইহাতে স্পষ্ট। যেন ইতিপূর্বে দেশে কোনও প্রগতিই ঘটে নাই, যাহা হইয়াছে তাহা কেবলই অবিচার। যে ‘নয়া ভারত’-এর কথা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার পার্ষদবর্গের কণ্ঠে পুনঃ পুনঃ ধ্বনিত হয়, তাহা এই রাজনীতিরই আদর্শরূপ। এই মতবাদের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়াই ভারতকে নূতন করিয়া সাজাইবার প্রয়াস, যাহার কারিগর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি ভাবিতেছেন, ইহাই স্মরণীয় রাষ্ট্রনেতা হইবার পথ; তাঁহার পূর্বে সকল কিছুই অকিঞ্চিৎকর, অতএব তিনিই রাষ্ট্রের রূপকার। অতীত কব্জা করিলেই ভবিষ্যৎটি তাঁহার। বিশ্বে এমন রাষ্ট্রনেতা আগেও দেখা গিয়াছে। গত শতাব্দীতে রোমানিয়ার কমিউনিস্ট একনায়ক নিকোলাই চাওসেস্কু-র আমলে বুখারেস্ট শহরের ঐতিহাসিক অংশটি প্রায় ধ্বংস করিয়া ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’র নিরিখে সাজানো হইয়াছিল। এই নেতারা মনে রাখেন না, ইতিহাসকে ছিঁড়িয়া ভাঙিয়া বিনষ্ট করিয়া যাহা তৈরি হয়, সেই ‘মূঢ়সম রাজদণ্ড’ সাধারণত চিরস্থায়ী হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amar Jawan Jyoti
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE