E-Paper

রাজসূয় পর্বের পরে

ভোট-রাজনীতির প্রকরণ হিসাবে এই ঘটনার গুরুত্ব আরওই স্পষ্ট হয়, যদি মনে রাখা যায় এই দেশে মন্দিরের কোনও অভাব নেই।

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:১৪
An image of ram temple

অযোধ্যার রামমন্দির। ছবি: পিটিআই।

অযোধ্যায় সোমবারের বিপুল সমারোহ এবং প্রদর্শনীকে রাজসূয় যজ্ঞ বললে অত্যুক্তি হয় না। বরং এই অভিধাটিই এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্বরূপটিকে নির্ভুল ভাবে উদ্ঘাটিত করে। অনুষ্ঠানটি আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয়, কিন্তু তার প্রকৃত লক্ষ্য রাষ্ট্রনায়কের আধিপত্যকে প্রবল ভাবে জাহির এবং কায়েম করা। সে-কালে, নানা ধর্মীয় ব্যাখ্যার আড়ালে, প্রকৃতপক্ষে এই উদ্দেশ্যেই রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন হত। যুগ বদলেছে, যজ্ঞের চেহারা এক থাকেনি, কিন্তু মৌলিক— কিংবা সনাতন— চরিত্রটি অবিচল। সন্দেহ নেই, সোমবারের ‘ধর্মানুষ্ঠান’ প্রভূত ক্ষমতা এবং অর্থের যৌথশক্তিতে নির্মিত এক অতিকায় প্রকল্প। মন্দির উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে উৎসাহ উদ্দীপনা উন্মাদনার যে অগণন দৃশ্য সমস্ত দেশ জুড়ে দেখা গিয়েছে, দেশ ও দুনিয়ার আপ্লুত ভক্তবৃন্দ এবং বিমুগ্ধ দর্শককুল যে ভাবে তাঁদের ভক্তি প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে ধর্মভাব ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে রাজভক্তি। অতঃপর আসন্ন নির্বাচনী উদ্যোগপর্বে শাসকরা এই দেশব্যাপী ভক্তির উপযুক্ত ব্যবহার করবেন, রামমন্দির-রাজসূয় আবেগকে ভোটের অঙ্কে রূপান্তরিত করতে তৎপর হবেন— ভক্তরাও নিশ্চয় তা জানেন।

ভোট-রাজনীতির প্রকরণ হিসাবে এই ঘটনার গুরুত্ব আরওই স্পষ্ট হয়, যদি মনে রাখা যায় এই দেশে মন্দিরের কোনও অভাব নেই। অভাব নেই সুবিশাল, ঐশ্বর্যশালী, রত্নভান্ডারে সমৃদ্ধ মন্দিরেরও, তাদের অনেকেরই দৈনিক উপার্জনের মাত্রা বহু সফল ব্যবসায়ীর মুনাফাকে ম্লান করে দিতে পারে। রামমন্দির যতই স্বর্ণভারে মণ্ডিত ও সজ্জিত হোক, দেশের অনেক মন্দিরের মধ্যে অন্যতম হিসাবেই তার ভবিষ্যৎ। মনে রাখতে হবে, এই দেশ জুড়ে বহু দেবালয় ঐশ্বর্যে ও আড়ম্বরে অকিঞ্চিৎকর হয়েও যুগ যুগ ধরে স্থানীয় বা আঞ্চলিক বা বৃহত্তর পরিসরের মানুষের পরম আশ্রয়ের স্থল হিসাবে বন্দিত হয়ে এসেছে— দেবতার সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক সেখানে ভয় বা সমীহের নয়, ঐশ্বর্য-মোহেরও নয়— ভালবাসার। ভারতবাসীর ধর্মের জগৎটি বরাবরই বহুবর্ণ, বহুরূপময়, বহুধা-প্রসারিত। ধর্মের নামে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের রকমারি উদ্যোগ তাঁরা দেখেছেন, নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও বিবেচনাবোধ দিয়ে তার বিচার করেছেন, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি থেকে প্রকৃত ধার্মিকতাকে পৃথক করে চিনে নিয়েছেন। কিন্তু এই বিশেষ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠাকল্পে যে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের সর্বগ্রাসী অভিযান চলল, অযোধ্যার অতিকায় উদ্বোধন যে ইতিহাস-অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা করল, তার অভিঘাতকেও কি তাঁরা আপন বিচারশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে পারবেন? ধর্মমোহের প্রবলতা থেকে ধর্মপ্রাণ নৈতিকতাকে আলাদা করে নিতে পারবেন?

সহজ প্রশ্ন নয়। রামমন্দির নিয়ে যে উচ্ছ্বাসে বান এসেছে, সোমবারের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’র পরে ক্রমে তার স্ফীতি প্রশমিত হতে পারে, সে-কথা উচ্ছ্বাসের কারিগররাও বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু সেই কারণেই, অনুমান করা চলে, যাঁরা এত যত্নে তা তৈরি করেছেন, তাঁরা ধর্মীয় প্রকরণগুলিকে আবার নতুন চেহারায় বা নতুন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করে চলার পরিকল্পনা করবেন। কেবল কাশী-মথুরার পরবর্তী অধ্যায় নয়, সামগ্রিক ভাবে হিন্দু জাগরণের এক নিরন্তর প্রক্রিয়া জারি রাখার রকমারি উদ্যোগ দেখা যাবে, এমন আশঙ্কা এখন নিশ্চিতি-রূপে দেখা দিয়েছে। সেই ধারাবাহিক তরঙ্গের অভিঘাতে ভারত ও ভারতবাসীর প্রকৃত ধর্মভাব এবং ধর্মভাবনা তার স্বধর্ম কতটা বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী অসম্ভব। তবে এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করছে পরবর্তী দিনে ভারতের চেহারা ও চরিত্র। রাজনীতিকে আর ধর্মকে আলাদা করে রাখার প্রয়াস কেউ করবেন কি না, করলে কী ভাবে করবেন, তার উপর কেবল ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে না, ভারতের সত্য ধর্মজীবনের গতিরেখাও সেই বিকল্প প্রয়াসের দিকেই তাকিয়ে থাকবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ayodhya Ram Mandir PM Narendra Modi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy