নেপালের পার্লামেন্টে যে বিচিত্র জট পাকাইয়াছে, তাহা কবির পঙ্ক্তি স্মরণ করাইয়া দেয়— “যাহা চাই তাহা ভুল ক’রে চাই/ যাহা পাই তাহা চাই না।” দলীয় কোন্দল সামলাইতে না পারিয়া মাঝপথে পার্লামেন্ট ভাঙিয়া দিয়াছিলেন প্রধানমন্ত্রী খড়্গপ্রসাদ শর্মা ওলি, এবং তাঁহার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনিয়াছিল বিরোধী গোষ্ঠী। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আড়াই মাস পরে পুনর্বহাল হইলেন ওলি। যদিও জনসভায় তিনি সাফাই গাহিয়া রাখিলেন, অনাস্থা প্রস্তাবে তাঁহাকে সরাইয়া দিলেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লইয়া ফিরিয়া আসিবেন। অর্থাৎ, নিরঙ্কুশ ক্ষমতাদখলের যে ইচ্ছায় ভর করিয়া আইনসভা ভাঙিয়াছিলেন তিনি, তাহা অদ্যাবধি বিদ্যমান। হয়তো স্রেফ সাংবিধানিক বাধ্যতা হইতেই কিঞ্চিৎ অনীহা লইয়াও দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন। বিপ্রতীপে, যাঁহারা সংখ্যার জোরে ওলিকে সরাইতে চাহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহারাও অনাস্থা প্রস্তাবে অগ্রসর হইতে ইচ্ছুক নহেন। সম্ভবত তাঁহারা বুঝিয়াছেন, সংবিধান গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারেরই পক্ষে।
কায়েমি স্বার্থ কী ভাবে রাজনৈতিক স্থিতি ধ্বংস করিতে পারে, বর্তমানের নেপাল তাহার পরীক্ষাগার। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রজাতন্ত্রের নূতন সংবিধান বলবৎ হইতে সকল রাজনৈতিক দলই মুক্তকণ্ঠে উহাকে স্বাগত জানাইয়াছিল, উহার ‘বহুত্ববাদী চরিত্র’-এর জন্য ‘বিশ্বশ্রেষ্ঠ’ আখ্যাও দিয়াছিল। শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এতাদৃশ সংশয়হীন ভাবে দেওয়া চলে না, সংবিধানের ন্যায় জটিল নীতিমালাকে তো নহেই, কিন্তু নেপালের সংবিধানে গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল প্রশ্নাতীত। রাজনৈতিক নেতারা প্রয়োজনে জনতার রায় গ্রহণ করিবেন, প্রয়োজনে তাহা লইয়াই ছেলেখেলা করিবেন, কখনও দল বা গোষ্ঠী পাল্টাইবেন, ইহা হইবার নহে। এবং জনতার রায় যে বিন্দুমাত্র অবহেলা করিবার উপায় নাই, তাহার প্রতিফলন ঘটিয়াছে আদালতের রায়ে। নেপালের শাসক কমিউনিস্ট পার্টির নেতানেত্রীগণ পাঁচ বৎসরের ভিতরেই সংবিধানকে হেয় করিবার চেষ্টা করিলেন বটে, তবে শেষাবধি দুধের বদলে পিটুলিগোলা লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে হইল।
কাঠমান্ডুর মেঘাচ্ছন্ন গগনে অবশ্য নয়াদিল্লির জন্য স্বর্ণালী রেখার ইশারা। বিগত কয়েক বৎসরে স্বাভাবিক মিত্র ভারতকে ছাড়িয়ে ক্রমশ বেজিং অভিমুখে ঝুঁকিয়াছেন ওলি। প্রচণ্ডের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী ওলি-বিরোধী হইলেও চিনবিরোধী নহে, তাহারাও বেজিং-এর ছায়াতেই অধিক স্বস্তি বোধ করে। অতএব, এক পক্ষে কূটনৈতিক স্তরে ভারতের সহিত সংঘাত, অপর পক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে চিনা প্রতিনিধির উপস্থিতি। এখন তাহা অতীত, দুই গোষ্ঠীই কিঞ্চিৎ দুর্বল। সরকারের ভিত মজবুত করিতে বৃহৎ শক্তি ভারতের মিত্রতা সহায়ক হইতে পারে, রাজনৈতিক ভাবে চিনের তত্ত্বাবধানও বিশেষ কার্যকর নহে। সহজ সত্যটি নয়াদিল্লি দ্রুত অনুধাবন করিয়াছে, এবং নেপালের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়ে প্রবেশ না করিয়াও মিত্রতায় উদ্যোগী হইয়াছে। তিন মাস পূর্বেই কাঠমান্ডু পৌঁছাইয়াছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরবণে ও বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। এই নূতন বোঝাপড়া নেপালের পক্ষে জরুরি। নয়াদিল্লির পক্ষেও। পুনঃস্থাপিত মিত্রতা এবং সংবিধান রক্ষার সংগ্রাম— বৃহৎ প্রতিবেশীকে দুই দিকেই নজর দিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy