—প্রতীকী ছবি।
বেশ কিছু দশক আগে, এডওয়ার্ড সাইদ প্যালেস্টাইন বিষয়ক বইতে লিখেছিলেন, আমেরিকা ও ইউরোপ যে ভাবে ধারাবাহিক সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে এসেছে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তিকে, তাতে এর ফলাফল অতি সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে। আরও এক বার তাঁর অন্তর্দৃষ্টি প্রমাণিত হচ্ছে পশ্চিম এশিয়ায়। এই মুহূর্তে ভয়াল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে ইজ়রায়েল এবং ইরান, দুই পরমাণু শক্তিধর ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র, মিসাইল হানায় পরস্পরকে তারা পর্যুদস্ত করতে বদ্ধপরিকর। লক্ষণীয়, যুধ্যমান দু’টি দেশেই প্রকট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অতীত প্রভাব, এবং সেই সঙ্গে তাদের আজকের বাস্তবে অতি প্রবল আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের যুগল ছায়া। উনিশশো সত্তরের দশকের ‘বিপ্লব’-এর ধারাবাহিকতা ইরান বহন করছে এখনও। তার সঙ্কীর্ণমনস্ক, রক্ষণশীল, অথচ রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে প্রবল রাষ্ট্রশক্তি সেই পূর্ব অভিজ্ঞতা-র স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। অন্য দিকে, ইজ়রায়েলের সঙ্গে আমেরিকার ও ইউরোপের সম্পর্ক সর্বজ্ঞাত। সাম্প্রতিক কালেও হামাস-বিরোধী অভিযানে প্যালেস্টাইনের এক বিরাট অংশ আক্ষরিক ভাবে গুঁড়িয়ে ও ধসিয়ে দেওয়ার সময় পশ্চিমের সক্রিয় সমর্থন বর্ষিত হয়েছে তার উপর। এ বারও ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর পৌঁছনো মাত্র আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন, তাঁর দেশের লৌহ-আবৃত (আয়রন-ক্ল্যাড) সমর্থন থাকতে ইজ়রায়েলের ভয় কী।
অর্থাৎ, এই মুহূর্তে আমেরিকা-পশ্চিম ইউরোপের সমালোচনা— ইউক্রেনে রাশিয়া কেন এ ভাবে সামরিক হামলা চালাচ্ছে। অন্য দিকে কিন্তু, ইজ়রায়েল যখন প্যালেস্টাইন ও ইরানে দু’হাতে দুই যুদ্ধের মন্দিরা বাজাচ্ছে, তাতে তাদের পূর্ণ সমর্থন। প্রধান বিশ্বশক্তি-সমূহের এই অসহনীয় দ্বিচারী ভূমিকাই এখন বিশ্বকূটনীতির সবচেয়ে বড় খবর। সন্দেহের কারণ নেই, দুই ক্ষেত্রেই ইজ়রায়েলের প্রতিক্রিয়ার পিছনে যথেষ্ট ‘ক্রিয়া’ বিদ্যমান। প্যালেস্টাইনি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হামাস ইজ়রায়েলে অভূতপূর্ব আক্রমণ হানায় তীব্র আতঙ্কের ঢেউ তৈরি হয়েছিল। অন্য দিকেও, ইরানই আগে ক্ষেপণাস্ত্র হানা শুরু করেছে, যদিও তার আগে দামাস্কাসে ইরানের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের উপর ‘অজানা’ আক্রমণে কয়েক জন নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রতাপশালী ‘রেভোলিউশনারি গার্ড’-এর দুই সদস্য। তবে, সমস্যা অন্যত্র। সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম হলেই এই ভাবে প্রবল সমরাভিযানের মাধ্যমে তার মোকাবিলা— একে কি আন্তর্জাতিক মান্যতা দেওয়া সঙ্গত, না নিরাপদ? যুদ্ধ কি এখন জলভাতে পরিণত? এটাই এখন বিধি যে, কোনও বেচাল দেখলেই অসামরিক জনসাধারণের উপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করা যায়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে এমন খোলামকুচির মতো একের পর এক দেশ যুদ্ধ-ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে, আর সকলে নিশ্চুপ, এমনকি সক্রিয়, সমর্থক? এ কেবল একটি-দু’টি রণাঙ্গনের বিষয় নয়, সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রস্ফুটিত আজ বিশ্বদুনিয়ার ব্যাপ্ত পরিসরে।
ভারতের স্বার্থের দিক থেকেও সঙ্কটজনক এই নতুন হিংসাপ্রবণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা। দিল্লির সঙ্গে ইরান ও ইজ়রায়েল দুই দেশেরই বন্ধুত্ব গভীর, সহযোগিতা ও আদানপ্রদানের সম্পর্ক দীর্ঘকালের। ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য ও কূটনীতির বন্ধন অচ্ছেদ্য: আমেরিকার খাতিরেও যে স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া যায়নি। অন্য দিকে, ইজ়রায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিভিত্তিক নির্ভরতা ভারতের কাছে গুরুতর— প্যালেস্টাইনের প্রতি ভারতীয় সহানুভূতির ইতিহাস সত্ত্বেও ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধতা দিল্লির কাম্য নয়। এমতাবস্থায় সতর্ক কূটনীতি চাই, আর তার জন্য ঠান্ডা মাথার রাষ্ট্রনীতিও চাই। সেই রাষ্ট্রনীতির প্রথম ও প্রধান উপাদান, প্রশ্নাতীত গণতন্ত্রের অধিষ্ঠান হিসাবে ভারতের বিশ্বখ্যাতি। আশা থাকল, আগামী নির্বাচনের ফল যা-ই হোক, এই ‘অধিষ্ঠান’টি অক্ষত থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy