E-Paper

বিচ্ছিন্ন

একই শহরের মধ্যে জন্ম নেবে আরও ক্ষুদ্র শহর, এক-একটি গণ্ডিবদ্ধ জীবন, যেখানে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মেলামেশা, আদানপ্রদান লক্ষণীয় ভাবে হ্রাস পাবে।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৩ ০৫:১১
ghetto and slums.

শহরের মধ্যে গেটোর উদ্ভব বিভাজনকে আরও তীব্র, এলাকাভিত্তিক করে তোলে। ছবি: রয়টার্স।

শহরের মধ্যে কি তৈরি হয়ে উঠছে ক্ষুদ্রতর, দেওয়াল-ঘেরা পরিচিতিভিত্তিক শহর, এই ভারতে? ভারতের প্রায় দেড় লক্ষ মহল্লার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশই মুসলিম, এমন মহল্লায় বাস করেন ভারতের সিকি ভাগ মুসলমান। যে মহল্লার বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত, দেশের ১৭ শতাংশ দলিত সেই মহল্লারই বাসিন্দা। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে তাঁরা নিজেরাই বেছে নিয়েছেন গেটো-বন্দি জীবন। গবেষণাপত্রটিতে ব্যবহৃত পরিসংখ্যান এক দশকেরও বেশি পুরনো, ২০১১ সালের জনগণনার। কিন্তু বারো বছর পূর্বের পরিসংখ্যান বলে তা অপ্রাসঙ্গিক নয়। বরং সমাজ এবং রাজনীতির চলন দেখে আশঙ্কা হয়, জাত-ধর্মের ভিত্তিতে গেটো-বন্দি থাকার প্রবণতা পূর্বের তুলনায় আরও বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতে বিজেপি সরকারের হাত ধরে যে নতুন মেরুকরণের যুগ শুরু হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতেও সেই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

একই শহরের মধ্যে জন্ম নেবে আরও ক্ষুদ্র শহর, এক-একটি গণ্ডিবদ্ধ জীবন, যেখানে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে মেলামেশা, আদানপ্রদান লক্ষণীয় ভাবে হ্রাস পাবে। ঠিক যেমনটি ইতিপূর্বে দেখা গিয়েছে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ বা ইউরোপে ইহুদিদের ক্ষেত্রে। ভারতের ক্ষেত্রে সেই জায়গাটি নিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং নিম্নবর্গের মানুষ। বহুধাবিভক্ত সমাজে ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বিদ্বেষ এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে নিজেদের সুরক্ষার প্রয়োজনেই সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়েছেন তাঁরা। কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ অধ্যুষিত এলাকায় সহজে বাসস্থান না পাওয়া, কখনও স্বাধীন যাপনে বাধার সৃষ্টি, কখনও আবার সুস্থ মেলামেশার পরিবেশ অনুপস্থিত থাকাও এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। শহরের মধ্যে গেটোর উদ্ভব বিভাজনকে আরও তীব্র, এলাকাভিত্তিক করে তোলে। যে সুরক্ষার খোঁজে শুধুমাত্র পরিচয় সম্বল করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা নিম্নবর্ণের মানুষপ্রান্তিক জীবনকে বেছে নেন, সেই প্রান্তিক জীবনই ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের আরও অ-সুরক্ষিত এবং কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আক্রমণের লক্ষ্য করে তোলে।

তা ছাড়া এ-হেন গেটোগুলির মূল সমস্যা— বাকি শহর স্বাভাবিক নিয়মে যে সুবিধা এবং স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে থাকে, গেটোর চৌহদ্দির মধ্যে তা সচরাচর প্রবেশ করতে পারে না। সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই ক্ষুদ্র গণ্ডিগুলি নিঃসন্দেহে প্রতিবন্ধক। গবেষণাপত্রেই প্রকাশ, শহরের মুসলিম, দলিত অধ্যুষিত এলাকাগুলি প্রায় সমস্ত সরকারি পরিষেবার ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকছে। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মুসলিম গেটোগুলিতে ধর্মীয় স্থানের সংখ্যা যত, স্কুলের সংখ্যা তদনুরূপ নয়। দিল্লির অধিকাংশ মুসলিম মহল্লা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ, যথাযথ নিকাশি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রহিত। অন্য দিকে, গেটোর বাইরে মূল শহরে অর্থনৈতিক কাজকর্মে যোগদানের সংখ্যাও যথেষ্ট কম। সর্বোপরি, এই বিচ্ছিন্নতা বোধ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটির পক্ষেও শুভ নয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, এবং আদানপ্রদানের স্বাভাবিক ধারাবজায় রাখা জরুরি। গেটোর সংখ্যাবৃদ্ধিতে তাই উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India Slums

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy