E-Paper

লক্ষ্মীর পরীক্ষা

প্রশাসনের খাতায় হয়তো লক্ষ্মীর ভান্ডার আরও একটি সরকারি প্রকল্প। যাঁরা এর রূপকার, সেই নেতারা সম্ভবত ভোটবাক্সে বাড়তি লাভের আশাতেই এটি নির্মাণ করেছিলেন।

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৪ ০৮:১২

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ফল বেরোনোর পর এক বিরল দৃশ্য দেখা গেল— সব দলের ঐকমত্য! লক্ষ্মীর ভান্ডারের কারণেই যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট টানা কঠিন হয়েছে, সে বিষয়ে একমত বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য সুনীল দাস, বিষ্ণুপুরের বিজেপি প্রার্থী সৌমিত্র খাঁ, সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য তুষার ঘোষ-সহ বেশ কিছু বিরোধী নেতা। রাজ্যের মেয়েদের ভোট গিয়েছে তৃণমূলের ভান্ডারে, তার ইঙ্গিতও মিলেছে— ঝাড়গ্রাম লোকসভার ভোটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের ভোট ৯২ শতাংশ গিয়েছে তৃণমূলে। ওই প্রকল্পই তার কারণ, মনে করছেন একাধিক তৃণমূল নেতা। তা থেকে এ-ও স্পষ্ট হয় যে, মেয়েরাই এ বার রাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের নির্ণায়ক। মেয়েরা যে ‘ভোটব্যাঙ্ক’, এমন একটি কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। তবে ‘ব্যাঙ্ক’ কথাটির মধ্যে নিশ্চিন্তে গচ্ছিত রাখার একটা দ্যোতনা রয়েছে। রাজ্যের পঞ্চায়েত, বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের ফল মিলিয়ে দেখলে কিন্তু এমন নিশ্চয়তার আভাস মেলে না— ভোটলক্ষ্মী সততই চঞ্চলা, মেয়েরাও বিনা প্রশ্নে একই দলকে সমর্থন করছেন, এমন নয়। তবে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে আর সংশয়ের অবকাশ নেই যে, এ রাজ্যে মেয়েরা এক বিশিষ্ট নির্বাচকমণ্ডলী হয়ে উঠেছেন। নিজেদের বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে তাঁরা স্থির করছেন, কোন বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবেন। ধর্ম, সম্প্রদায়, প্রশাসনিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষপাতিত্ব ও প্রতারণা, নারী-হিংসা— এমন নানা নির্বাচনী বিষয়ের মধ্যে তাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটিকে ‘পাখির চোখ’ ধার্য করেছেন। কিছু টাকার প্রাপ্তিকে গুরুত্ব দেওয়াটা মেয়েদের রাজনৈতিক চেতনার অভাব নয়— এটা মেয়েদের সচেতন নির্বাচন, যা তাঁদের জীবন-সঞ্জাত রাজনৈতিক বোধের প্রকাশ।

রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতার ভারসাম্য। মেয়েদের ক্ষমতায় ঘাটতি চিরকালের, অথচ আজ তাঁদের দায়িত্বের বোঝা বাড়ছে। এক দিকে সংসার পরিচালনা ও সন্তান প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব, অন্য দিকে লিঙ্গবৈষম্যে দুষ্ট এক বাজারব্যবস্থার মোকাবিলা করে জীবিকা অর্জনের দায় বইতে হচ্ছে অধিকাংশ মেয়েকে। শহর-গ্রাম থেকে পুরুষদের ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার হার যত বেড়েছে, ততই মেয়েদের উপর দৈনন্দিন সংসার-খরচ জোগানোর দায় চেপেছে। পাশাপাশি সরকারি পরিষেবা বেহাল হওয়ার ফলে উনুনের জ্বালানি থেকে শিশুর চিকিৎসা, সবই মেয়েটিকে জোগাড় করতে হচ্ছে নিজের শ্রম বা খরচে। বেতনহীন গৃহশ্রম, মজুরিতে ঘাটতি ও দীর্ঘ কর্মদিবস, পরিবারের টাকা নিজের ইচ্ছায় খরচ করার অক্ষমতা— সব মিলিয়ে মেয়েদের জীবনযাত্রা দুঃসহ। গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে যথাযথ পারিশ্রমিক এবং সম্মানজনক কাজের শর্ত দাবি করে যত আন্দোলন হয়েছে, তার পুরোধা ছিলেন মেয়েরা। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মী, সাফাই কর্মী, চা বাগানের কর্মী-সহ বহু পেশায় মেয়েরা নেতৃত্বে এসেছেন, এবং মেয়েদের জীবন-জীবিকার সঙ্কটের প্রতি সরকার ও সমাজের উদাসীনতাকে আঘাত করেছেন। মেয়েদের শ্রমের স্বীকৃতির দাবি নিয়ে দীর্ঘ, ধারাবাহিক আলোচনা রাজনীতির মূলস্রোতে তেমন প্রভাব না ফেললেও জীবিকার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার শক্তি হয়তো জুগিয়েছে এতগুলি মেয়েকে।

প্রশাসনের খাতায় হয়তো লক্ষ্মীর ভান্ডার আরও একটি সরকারি প্রকল্প। যাঁরা এর রূপকার, সেই নেতারা সম্ভবত ভোটবাক্সে বাড়তি লাভের আশাতেই এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের মেয়েরাও এর অর্থ নির্মাণ করছেন। মাসে হাজার টাকা কিংবা বারোশো টাকা কেবল কিছু অর্থসাহায্য নয় (যদিও তার মূল্যও একটি দরিদ্র মেয়ের কাছে কম নয়), তা বস্তুত মেয়েদের উপর সামূহিক অন্যায়ের স্বীকৃতি, ও তার সংশোধনের প্রয়াস। জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এই সত্যটি দেখা প্রয়োজন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

women voters West Bengal Women

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy