বিহারের ভোটের ফল অপ্রত্যাশিত, এমন দাবি করা যাবে না। কিন্তু, যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এনডিএ ক্ষমতায় ফিরল, তার তাৎপর্য অনস্বীকার্য। বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের পরেই ছিল এই নির্বাচন। সেই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নগুলি উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের কারণেই এনডিএ এমন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরল, এমন দাবিও রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা। প্রথমে বলা প্রয়োজন, এই জয় নিঃসন্দেহে নীতীশ কুমারের পক্ষে স্পষ্ট জনাদেশ। তার পাশাপাশি, অনতিঅতীতের কিছু বিধানসভা ভোটের সঙ্গে বিহারের ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান চলন সম্বন্ধে কিছু কথা বুঝে নেওয়া যেতে পারে। প্রথম কথাটি হল, যাকে ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি’ বা শাসক-বিরোধী মনোভাব বলা হয়, ভারতীয় রাজনীতিতে তার মাহাত্ম্য কমেছে। এই প্রবণতাটির পিছনে রয়েছে রাজনীতির একটি সুনির্দিষ্ট দিকবদল— বিশেষত রাজ্য স্তরের রাজনীতি এখন বহুলাংশে প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরভিত্তিক উন্নয়ন নীতির উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, সরকারের কাছে নাগরিকের প্রত্যাশা আর সুশাসন নয়, প্রত্যক্ষ নগদ। যে দল ক্ষমতায় আছে, এবং যার নগদ বা অন্য সুবিধা দেওয়ার ক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত, তাকে প্রত্যাখ্যান করার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ অনেক ভোটারই খুঁজে পান না। বিশেষত, তার পিছনে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন থাকে, তা হলে বিরোধীদের পক্ষে প্রতিশ্রুতির লড়াই জেতা মুশকিল। বিহারের ফল দেখে অনুমান করা চলে, মহিলা রোজগার যোজনা প্রকল্পে দশ হাজার টাকা করে প্রাপ্তি এনডিএ-র দিকে বিপুল মহিলা ভোট টেনেছে।
দ্বিতীয় কথা, অপশাসনের স্মৃতি হয়তো সহজে মোছে না। অন্তত এত কম সময়ে মোছে না। বিহারে আরজেডি-কে মানুষ সম্ভবত তার অপশাসনের পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে সম্মত নয়। এই নির্বাচনের প্রচারপর্বেও এনডিএ ‘নব্বইয়ের দশকের জঙ্গলরাজ’-এর প্রত্যাবর্তনের ভীতিকে উস্কে দিতে চেয়েছে— সম্ভবত সফলও হয়েছে। আরও একটি ক্ষেত্রেও কি অতীত প্রভাব ফেলল আরজেডি-র সম্ভাবনায়? লালু প্রসাদ যাদবের আমলে যাদবদের আধিপত্য রাজ্যের অন্যান্য ওবিসি, এবং দলিত জনগোষ্ঠীর মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিল। আরজেডি এখনও সেই যাদব-মুসলমান সমীকরণ থেকে বেরোতে পারেনি। ফলাফল দেখে অনুমান করা চলে, এনডিএ জোট বরং বিহারের অতি জটিল জাতভিত্তিক প্রশ্নটিকে অনেক ভাল সামলেছে। এমনিতেই জাত-অঙ্কে গোড়াতেই এনডিএ-র দিকে পাল্লা ভারী ছিল। বিজেপির উচ্চবর্ণ ভোটের পাশাপাশি নীতীশ কুমারের ‘অতি পিছড়া’ ভোট, এবং চিরাগ পাসোয়ানের দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তন— সব মিলিয়ে বিহারের রাজনীতির অঙ্কটি এনডিএ খুবই সহজে মেলাতে পেরেছে।
বিপরীতে, তেজস্বী-রাহুল জুটি উপরে বর্ণিত কাজগুলির একটিও যেমন পারেননি, তেমনই তাঁরা রাজনীতিতে এমন কোনও নতুন একটি বয়ান তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছেন, যা মানুষকে তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট করে। ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’-র মাধ্যমে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, আসন বণ্টন নিয়ে পারস্পরিক তরজায় তা খোয়া গেল। রাজনীতির মাঠে পড়ে থাকা যাকে বলে, সে কাজটি এই দুই নেতার এক জনও করতে পারলেন না। আবার, চেনা খেলার বাইরে কোনও নতুন সম্ভাবনাও তাঁরা তৈরি করতে পারলেন না। সে কাজটি করার চেষ্টা করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর, যদিও আসনের দিক থেকে তিনি প্রশ্নাতীত ভাবে ব্যর্থ। এও এক শিক্ষা— শুধু দিন পাল্টানোর প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট নয়, শাসকের বিকল্প হিসাবে কাউকে বেছে নেওয়ার আগে মানুষ সে নেতার ধারাবাহিকতা দেখতে চান। মোটের উপরে, মানুষ এখন স্থিতিশীলতায় ভরসা করতেই স্বচ্ছন্দ। বিহারে এনডিএ-র জয় সেই স্থিতিশীলতার জয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)