ধর্ষণের বিচার চাইলে কেবল ধর্ষককে কাঠগড়ায় তুললেই হয় না। তুলতে হয় সমাজ, প্রশাসনকে, রাজনীতিকে। সম্প্রতি ভারতের তিনটি রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত ধারাবাহিক সংবাদ প্রতিবেদন (‘বিপন্ন মেয়ে’, ৪-৬ অগস্ট) ফের সে কথাকেই স্পষ্ট করল। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ধর্ষণের ঘটনা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে কম যে রাজ্যগুলিতে, তার মধ্যে রয়েছে নাগাল্যান্ড, মাত্র সাত (২০২১)। সেখানে মধ্যপ্রদেশে ধর্ষণের সংখ্যা সাত হাজার (২০২৪)। কী করে ব্যাখ্যা করা যায় এই পার্থক্যকে? নারীশিক্ষা, মেয়েদের রোজগারের নিরিখে তামিলনাড়ু ভারতে উন্নততম রাজ্যগুলির অন্যতম, অথচ সেখানেও বেড়ে চলেছে ধর্ষণ, নারী নিগ্রহের ঘটনা। শিকড় এমনই গভীরে ঢুকেছে যে, গত জুন মাসে কাঞ্চীপুরমে পড়া বুঝে নেওয়ার ছলে একাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে ডেকে এনে ধর্ষণ করেছিল অষ্টম শ্রেণির দুই ছাত্র। পশ্চিমবঙ্গ ধর্ষণের সংখ্যার নিরিখে দশম স্থানে, কলকাতাও ভারতের বড় শহরগুলির মধ্যে নিরাপত্তায় শীর্ষের দিকে। কিন্তু আর জি কর ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ড থেকে কসবা আইন কলেজে ছাত্রীধর্ষণের ঘটনায় এ সব পরিসংখ্যান যেন অর্থ হারিয়েছে। এই সময়ে অন্যান্য রাজ্যের প্রেক্ষিতটি প্রয়োজনীয়। নাগাল্যান্ড, তামিলনাড়ু বা মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-সংস্কৃতির ভিন্নতা রয়েছে। যে কোনও সমাজেই ধর্ষণের কারণ জটিল, অথচ কেন স্কুলপড়ুয়া কিশোরের মধ্যেও ধর্ষকাম মনোবৃত্তির বৃদ্ধি, তার সূত্র না খুঁজলেই নয়।
পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থার সূচনা হয় সমাজে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে মূল্যবোধ তৈরি করে, তা মানুষকে সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে সতর্ক করে। এ বছরই মে মাসে নাগাল্যান্ডের পেরেন জেলায় একটি গ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ধর্ষণ-অভিযুক্ত এক প্রবীণ ব্যক্তি গ্রামে ঢুকতে পারবেন না। এমন সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ ধর্ষণ-নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হতে পারে। যদিও এমন পুরনো ব্যবস্থাগুলি সর্বদা মেয়েদের স্বাতন্ত্র্য, সক্ষমতাকে প্রশ্রয় দেয় না। এমনকি সেখানে প্রচ্ছন্ন ভাবে গার্হস্থ নির্যাতনে প্রশ্রয় লুকিয়ে থাকতে পারে। সমকালীন সামাজিক আন্দোলনও অবশ্য এমন সম্মিলিত প্রতিরোধ তৈরি করেছে, যার অন্যতম নিদর্শন, গত কুড়ি বছরে বাংলাদেশে মেয়েদের উপরে অ্যাসিড আক্রমণের ঘটনায় হ্রাস। অসরকারি উদ্যোগ, সংবাদমাধ্যমের সক্রিয়তা এবং সরকারি সহযোগিতায় অ্যাসিড-আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসা, রোজগার, সামাজিক সম্মানের ব্যবস্থা হয়, এবং অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হয়। কিন্তু এমন দৃষ্টান্ত বিরল। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, ফলে পুরনো রীতিনীতির নিয়ন্ত্রণ কমছে। নিয়ন্ত্রণ, নজরদারির দায়িত্ব বর্তাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসন, আর কতিপয় অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির উপর। কিন্তু সর্বজনীন নিরাপত্তার জন্য যে পর্যায়ে নজরদারি ও সমন্বয় থাকা দরকার পুলিশ-প্রশাসনের নানা বিভাগের, তা দেখা যাচ্ছে না। আজও কর্মরত মেয়েরা জানেন না, যৌন হয়রানির অভিযোগ লেখানোর জন্য জেলাশাসকের সভাপতিত্বে কমিটি (এলসিসি) রয়েছে।
লক্ষণীয় এই যে, মেয়েদের ভোট আদায়ে সব দলই সমান তৎপর। গত দু’দশকে প্রায় সব দলের সরকার মেয়েদের জন্য অনুদান বাড়িয়েছে, স্বরোজগার, প্রশিক্ষণে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। পুলিশে, প্রশাসনে, আদালতে মহিলাদের নিয়োগও বেড়েছে। তবুও রাজনীতিতে ক্রমশ ক্ষীণ হয়েছে মেয়েদের কণ্ঠ। জয়ললিতা বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শীর্ষ নেত্রীদের হাতে রাজনীতি অসীম ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু মেয়েদের সক্ষমতার জন্য তাঁরা কী করেছেন? তাঁদের শাসনকালে মেয়েদের কণ্ঠ দুর্বল হয়েছে, কারণ সামগ্রিক ভাবে দুর্বল হয়েছে গণতন্ত্র। বিরোধীর স্বর স্তব্ধ করলে মেয়েদেরও চুপ করতে হয়, কারণ পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মেয়েরা চিরবিরোধী। যুক্তিবিরোধী, মানবতাবিরোধী আধিপত্যের রাজনীতি যে ধর্ষকাম মানসিকতা তৈরি করছে, তার প্রতিরোধ করুক নাগরিক সমাজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)