Advertisement
২০ মে ২০২৪
Mamata Banerjee

ঘুঘু এবং ফাঁদ

২০১৯ সালে দেশব্যাপী এক সমীক্ষা জানাইয়াছিল, বৈধ রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও আধার সংযোগের অভাবে ন্যায্য প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন ২৮ শতাংশ মানুষ।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:২৯
Share: Save:

খবরে প্রকাশ, দুই কোটি ভুয়া রেশন কার্ডের সন্ধান পাইয়াছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ইতিমধ্যে এক কোটি চিহ্নিত, আরও এক কোটি ধরিতে পারিলে রাজ্য প্রশাসনের বৎসরে আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হইতে পারে। উদ্যোগটি জরুরি— ক্ষমতায় আসিয়াই খাদ্য দফতরকে ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা’ বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সেই দিকে নজর দিয়াছিলেন। অতঃপর দশ বৎসর কাটিয়াছে, কিন্তু দুর্নীতির প্রশ্নটি নির্মূল হইয়াছে বলা যাইবে না; তৃতীয় বার সরকারে আসিয়াও দোকানে-দোকানে ঘুরিয়া রেশন-দুর্নীতি দেখিতে হইয়াছে নবনিযুক্ত খাদ্য প্রতিমন্ত্রী জ্যোৎস্না মান্ডিকে। অতএব, রেশনে দুর্নীতি ধরিবার আর এক নূতন পন্থার কথা শুনিতে হইলে প্রশ্ন জাগিবেই। মূল কথাটি হইল, রেশনে দুষ্টচক্র ভাঙিবার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সদিচ্ছা থাকিলে কি এত কাল ধরিয়া তাহা চলিতে পারিত? অসাধু ডিলারেরা যে রেশনের মাল অন্যত্র বেচিয়া দেন, এই কথা জনসাধারণ অবগত, অথচ পুলিশ-প্রশাসন অন্ধকারে? ইহা কি বিশ্বাসযোগ্য? দুর্নীতি ধরিবার পন্থা বদলাইয়া বিশেষ লাভ নাই, যদি না সরকার অনিচ্ছুক মনোভাবটি পাল্টাইতে পারে।

প্রশ্ন থাকিবে এই পর্বে দুর্নীতি চিনিবার মানদণ্ড লইয়াও। সরকার বলিয়াছে, আধার-সংযোগের মাধ্যমেই রেশনে দুর্নীতির হিসাবটি বুঝিয়া লওয়া হইবে। কিন্তু আধার-দুর্নীতিও আজ রেশনের ন্যায় জলভাত, টাকার বিনিময়ে ভুয়া কার্ড করানো, অথবা ঘুষ লইয়া কাহারও আধারের তথ্য ফাঁস করিয়া দিবার অসাধু চক্রের সংবাদ একাধিক বার সামনে আসিয়াছে। পাঁচ বৎসর পূর্বে সংসদে স্বয়ং আইনমন্ত্রীর মুখে ৪৯,০০০ ভুয়া আধার নিবদ্ধীকরণ কেন্দ্রের কথা শুনা গিয়াছিল। যে আধার নিজেই সন্দেহের অতীত নহে, তাহাকে অন্য এক দুর্নীতি মুছিবার ভিত্তিরূপে দেখিলে জিজ্ঞাসা উঠাই স্বাভাবিক। দুর্জনে বলিবে, কেন্দ্রের ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’ হউক, বা রাজ্যের আধারযুক্ত ডিজিটাল রেশন কার্ড— সকলই বাগাড়ম্বরমাত্র। আসল সঙ্কট না মিটাইয়া নব নব মোড়কে প্রতিশ্রুতি তুলিয়া ধরা। বস্তুত, ইহাতে একাধিক দুর্নীতি জড়াইয়া এক আঁতাঁত তৈরি হইবার আশঙ্কা প্রকটতর হইয়া উঠিতে পারে।

আধারযুক্ত রেশন কার্ড লইয়া জনসাধারণের হয়রানি সেই আশঙ্কাই স্পষ্ট করে। ২০১৯ সালে দেশব্যাপী এক সমীক্ষা জানাইয়াছিল, বৈধ রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও আধার সংযোগের অভাবে ন্যায্য প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন ২৮ শতাংশ মানুষ। অধিকাংশ ভ্রান্তিই প্রশাসনের— কোথাও লিঙ্ক ফেল করিয়া থাকে, কোথাও বায়োমেট্রিক যন্ত্রে গোলযোগ, এবং শেষাবধি উপভোক্তাদের সংযোগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় না। এমনকি, বহু ক্ষেত্রেই ‘ভুয়া’ বলিয়া বাতিল হওয়া রেশন কার্ডের মালিকেরা জীবিত ও বৈধ। অর্থশাস্ত্রী জঁ দ্রেজ় তাই গণবণ্টন ব্যবস্থায় এই ‘আলটিমেটাম মেথড’ বা চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দিবার প্রক্রিয়ার ফাঁদ সম্পর্কে বারংবার সাবধান করিয়াছেন। আধার বানাইবার প্রক্রিয়া যে হেতু সহজ নহে, তাহাতে দুর্নীতিরও প্রভূত অবকাশ, অতএব শেষাবধি দেশের দরিদ্রতম জনসংখ্যার ন্যায্য অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবার ভয়টি প্রবল। রেশনে খাবার না পাইয়া একাদশবর্ষীয়া সন্তোষ কুমারীর মর্মান্তিক মৃত্যু ভারত নিশ্চয়ই এত দ্রুত বিস্মৃত হয় নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee Fake Ration Card
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE