কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা দায় হয়ে উঠেছে। একের পর এক দুর্ঘটনায় পথচারীদের মৃত, আহত হওয়ার ঘটনাই তার প্রমাণ। পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ২০২৩ সালে পথ-দুর্ঘটনায় মৃতদের চল্লিশ শতাংশের অধিকই পথচারী। ২০২৪ সালের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনও পাওয়া না গেলেও পরিস্থিতির যে বিশেষ উন্নতি হবে না, পুলিশ আধিকারিকরাও তাতে নিশ্চিত। পথ-দুর্ঘটনার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠে গাড়িচালকের দিকে। গাড়ি ভাঙচুর, চালককে গণপিটুনি, অবরোধ— রাজপথের নিত্যনৈমিত্তিকতায় পর্যবসিত। কিন্তু, এই সমস্ত দুর্ঘটনার একটি লক্ষণীয় অংশ জুড়ে থাকে পথচারীদের বেপরোয়া মনোভাব। সিগন্যাল, জ়েব্রা ক্রসিং না মেনে, মোবাইল কানে, চলন্ত গাড়ির স্রোতের মাঝখান দিয়ে ছুটে রাস্তা পারাপারই এখন স্বাভাবিক চিত্র। এই আচরণে লাগাম পরাতে সম্প্রতি কলকাতা পুলিশ শহরের ব্যস্ততম মোড়গুলিতে আইনভঙ্গকারীদের হাতে পরিয়ে দিয়েছিল কব্জিবন্ধনী, যাতে লেখা— আইন ভেঙে রাস্তা পারাপার এড়িয়ে চলুন।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় অর্থনীতিবিদ রিচার্ড থেলার-এর ‘নাজ থিয়োরি’র মূল কথাটি— পরিপার্শ্বের ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে আরও ভাল সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করা। মর্মান্তিক পরিণতি জেনেও যাঁরা তার তোয়াক্কা করেন না, হাজার প্রচারেও টনক নড়ে না, তাঁদের সতর্কবাণী সম্বলিত রাখি পরিয়ে দেওয়ার অর্থ কৃতকর্মের জন্য লজ্জাবোধ জাগানোর চেষ্টা। এই বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ প্রতীক হিসাবে চমৎকার, তবে মূল সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা নিশ্চিত ভাবেই শূন্য। যে রোগের শিকড় বহু দূর বিস্তৃত, তার প্রতিরোধে কড়া দাওয়াই প্রয়োজন। যে দাওয়াই প্রয়োগে শহরের পুলিশ-প্রশাসন নিতান্তই অনিচ্ছুক। যত্রতত্র রাস্তা পেরোলে বর্তমান আইনে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা জরিমানা ধার্য করার কথা। নেওয়া হয় ১০ টাকা। কিন্তু যে বিরাট সংখ্যক মানুষ নিয়মিত আইন ভাঙেন, তার মধ্যে কত জনের কাছ থেকে ওই সামান্য পরিমাণ জরিমানা আদায় করা হয়? পুলিশ হয় বিষয়টি অগ্রাহ্য করে, নয়তো ধমকেই কাজ সারে। এই ‘মহানুভবতা’ অন্যায়কারীকে ফের অন্যায়ে প্রশ্রয় দেয়।
এই শহরে ফুটব্রিজ, পাতালপথের ব্যবস্থা বিস্তর। তবু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অকেজো হয়ে থাকে। কিছু জায়গায় গার্ডরেল, দড়ি ব্যবহারে সাফল্য এলেও অধিকাংশ জায়গাতেই অনিয়মই নিয়ম। এ-হেন আচরণের পরিবেশগত মূল্যটিও কম নয়। চলন্ত গাড়ির স্রোত পথচারীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলে যানজট বাড়ে, জ্বালানি অধিক পোড়ে, দূষণ বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে ‘হালকা ঠেলা’ নয়, আইনের গুঁতো জরুরি। জরিমানার অঙ্ক বৃদ্ধি এবং তার প্রয়োগে কঠোরতা দুই-ই আবশ্যক। যে জায়গায় ফুটব্রিজ, আন্ডারপাস আছে, সেগুলি ব্যবহার করতে পথচারীদের বাধ্য করতে হবে। সমগ্র বিষয়ে নজরদারির জন্য পুলিশে অতিরিক্ত নিয়োগ করতে হবে কি না, ফুটব্রিজ-আন্ডারপাসের সংখ্যা বৃদ্ধি বা যেগুলি আছে তাদের চলাচলযোগ্য করে তুলতে হবে কি না, সেগুলি প্রশাসন দেখবে। পথচারীদের নিরাপত্তা দান এবং গাড়ি চলাচল মসৃণ রাখা— উভয়ই প্রশাসনিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দায়িত্ব পালনই এখানে প্রকৃত ‘জনদরদি’ ব্যবহার, সে কথা প্রশাসনকে বুঝতে হবে বইকি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)