E-Paper

দায়বদ্ধ

সরকারের যুদ্ধং দেহি ভাবটি প্রকট করলেই নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। অথচ সেই ভার সরকারকে নিতেই হবে।

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:২১

দুর্যোগ, দুর্ঘটনা বা সন্ত্রাসবাদী হামলা, ভারতের মতো জনভারপীড়িত দেশে সব কিছুরই পরিমাপ হয় সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে— যে হানি ওক্ষতি যত বেশি বা গভীর, সেই ঘটনার প্রভাব ও স্মৃতিও ততই। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসের সন্ধ্যায়, খাস রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাগুলির একটিতে, ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভিড়ে যদি বিস্ফোরণ হয়, তার অভিঘাত কী হতে পারে ভাবতেও আতঙ্ক জাগে। দিল্লির লাল কেল্লার কাছে গত সোমবার গাড়ি-বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী ও তাৎক্ষণিক বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মী হয়ে উঠেছিলেন যাঁরা, তাঁদের বয়ানগুলি হৃদয়বিদারক: তীব্র বিস্ফোরণে গোটা এলাকা কেঁপে যাওয়া, আকাশে আগুনের শিখা ছিটকে ওঠা, আশপাশের আরও কয়েকটি অগ্নিদগ্ধ গাড়ির কাচ ভেঙে গলে যাওয়া দেহ উদ্ধার— সিনেমার পর্দাতেও যা দুঃস্বপ্নের মতো, চোখের সামনে তা সত্য হয়ে উঠল। সরকারি হিসাবে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, বেসরকারি হিসাবটি অনেক বেশি; আর শোক ও আতঙ্কের তো হিসাব হয় না কোনও।

ভারতে প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের সঙ্গে সন্ত্রাসের এক প্রায়-অচ্ছেদ্য যোগ আছে। দিল্লির ক্ষেত্রেও গত আটচল্লিশ ঘণ্টার ঘটনাক্রমে সেই যোগসূত্রের অনুসন্ধান চলছে, বিশেষত অতি সম্প্রতি দিল্লির কাছে হরিয়ানার ফরিদাবাদে পুলিশি অভিযানে প্রায় তিন হাজার কেজি বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্রের উদ্ধার, জঙ্গি-যোগ সন্দেহে ধরপাকড় ও বেশ কয়েকজনের গ্রেফতারিতে এই সন্ত্রাস-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সরকারি সিলমোহরটুকুই শুধু পড়া বাকি। এনআইএ, এনএসজি, আইবি ও দিল্লি পুলিশ ইত্যাদি সংস্থা মিলে সেই কাজ করছে, দোষী কেউই পার পাবে না— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রীও তা জানিয়েছেন। সাধারণ নাগরিকেরা এই আশ্বাসটুকু চান নিশ্চয়ই, কিন্তু তারও আগে চান কিছু প্রশ্নের উত্তর। প্রশ্নগুলি গোড়ার— সাধারণ মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা বিষয়ক। গাড়ি-ভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে এক জন সাতসকালে টোল প্লাজ়া পেরিয়ে দিল্লি ঢুকছে, সারা দিন ব্যস্ত রাজধানীর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, নির্দিষ্ট পার্কিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছে, দিল্লি পুলিশের নজরদারিতে কোথাও কখনও তা ধরা পড়ল না? গোয়েন্দা সংস্থাগুলির এ কথা মনে হল না যে, দিল্লির অদূরে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ধরা পড়াই শেষ কথা নয়, বাকি আরও বিস্ফোরক সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হতে পারে, এবং রাজধানীর নিরাপত্তায় তা এক সাংঘাতিক ঝুঁকি? কে বা কারা এই ঘটনায় জড়িত সেই তদন্ত তো পরের কথা, এই বিস্ফোরণ কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ বা জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির দায়বদ্ধতা ও দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল না?

ভারতের বর্তমান শাসকেরা রাজনৈতিক বয়ানকে জাতীয় বয়ান করে তোলার কাজটিতে সিদ্ধহস্ত। পহেলগামের স্মৃতি এখনও মানুষ ভোলেননি, সেই ঘটনার পর কেন্দ্র যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হানাকে ‘যুদ্ধ’ বা ‘অ্যাক্ট অব ওয়র’ বলে বিবেচনার নীতি নিয়েছে। যুদ্ধের জন্য একটি প্রতিপক্ষ প্রয়োজন হয়, লাল কেল্লার বিস্ফোরণে সেই প্রতিপক্ষটি এখনও পর্যন্ত খাড়া করা যায়নি বা হয়নি বলে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াগুলি এখনও পর্যন্ত ‘ষড়যন্ত্রকারী’, ‘হান্ট ডাউন’, ‘শেষ দেখে ছাড়া’, ‘নিরাপত্তা সংস্থার চরম রোষ’ গোছের শব্দাবলিতে পরিকীর্ণ। শব্দবিতরণই সার, শেষ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। গোয়েন্দা তৎপরতার অভাব এর বড় কারণ, পহেলগাম যার সাক্ষাৎ প্রমাণ। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় পঠানকোট, উরি, পুলওয়ামা, পহেলগামের ঘটনা ঘটার পর খাস রাজধানীতে এমন প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটল। গত ত্রিশ বছরে দিল্লিতে বিস্ফোরণ ও সন্ত্রাসী হানার ঘটনা কম নয়: ২০০৫, ২০০৮ ও ২০১১ ভাবা যেতে পারে। ঘটনা হল, বহু বাগ্‌বিস্তার সত্ত্বেও সন্ত্রাসের ছায়া একই ভাবে বিরাজমান। সরকারের যুদ্ধং দেহি ভাবটি প্রকট করলেই নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। অথচ সেই ভার সরকারকে নিতেই হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Security Delhi terror attack

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy