চলচ্চিত্র ইতিহাস-আশ্রয়ী হলেও তা খাঁটি ইতিহাস কি না, এই তর্কটি অনেক দিনের। এ কথা সত্য যে, দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যম হওয়ার জোরে সিনেমা যে ভাবে যে কোনও বিষয়কে দর্শকের মনে গেঁথে দিতে পারে তার জুড়ি নেই। আবার এখানেই নিহিত এক বিরাট ঝুঁকিও: সিনেমার মোড়কে ইতিহাসের অপলাপও মানুষ গোগ্রাসে গিলে নিতে পারেন, তাকেই সর্বসত্য বলে বিশ্বাস করতে পারেন, কারণ ‘পর্দায় দেখিয়েছে’। বায়োপিক বা জীবননির্ভর চলচ্চিত্রেও এই ঝুঁকি যে থাকে না তা নয়, তবে একটি মহৎ বা গুণান্বিত জীবনের শুরু থেকে হয়ে-ওঠা অবধি সব কিছুই সেখানে সময় ও সমাজের আয়নায় দেখাতে হয় বলে ছবিটি শেষ বিচারে হয় মাটির কাছাকাছি, বাস্তবসম্মত। সাম্প্রতিক অতীতে মুক্তিপ্রাপ্ত ছাওয়া এবং সদ্য প্রেক্ষাগৃহে আসা ছবি ফুলে-র মধ্যে তফাত এই— প্রথমটি ইতিহাস ছুঁয়েও জ্ঞানত কল্পনা ও অতিরঞ্জন-নির্ভর এক ‘পিরিয়ড ফিল্ম’, আর দ্বিতীয়টি আগাগোড়া জ্যোতিরাও ও সাবিত্রীবাই ফুলের জীবনকে তুলে ধরে উনিশ শতকের মহারাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে: অকপট।
এই অকপটতাই কি কোনও কোনও সিনেমার ভাগ্যবিড়ম্বনার কারণ? ফুলে ছবিটি নিয়ে সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে, তার জেরে ছবির মুক্তির তারিখও বদলাতে হয়েছে। ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে তার ‘টিজ়ার’ ও ‘ট্রেলার’-এর প্রচার এ কালের অতিচর্চিত প্রথা, সেটুকু দেখেই মহারাষ্ট্রের তিনটি ব্রাহ্মণ সংগঠন হইচই শুরু করেছিল, এ ছবিতে ব্রাহ্মণদের দেখানো হয়েছে আগাগোড়া নেতিবাচক ভাবে, এতে তাঁদের ভাবাবেগ আহত হয়েছে। সমাজমাধ্যমেও ঘনিয়ে ওঠে চাপান-উতোর, অনুরাগ কাশ্যপের মতো চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব ছবিটির সপক্ষে বলতে গিয়ে তর্কের আবহে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে রুচিবিগর্হিত মন্তব্য করে পরে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। এর আগেই সেন্সর বোর্ডও ছবিটিতে অল্পবিস্তর পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিল, তা নিয়েও কথা ওঠে। সব মিলিয়ে যে চিত্রটি সামনে উঠে আসে তা এই ভারতে নতুন নয়, গত কয়েক বছরে নানা ছবি মুক্তির আগেই এই ঘটনা ঘটেছে— কখনও বিজেপি-আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, কখনও অন্য ছোট-বড় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বা সংগঠন নানা সিনেমার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছে। তাদের দাবিদাওয়া সর্বদাই ঘোরাফেরা করেছে মোগল-রাজপুত/মরাঠি, হিন্দু-মুসলমান’এর মতো ‘বনাম’-এর রাজনীতি কেন্দ্র করে। ফুলে ছবিটিও যে এই মানসিকতার মানুষদের ধর্মে সইবে না তা সহজেই অনুমেয়, কারণ এই ছবির কেন্দ্রে যে দু’টি জীবন তাঁদের আমৃত্যু লড়াই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, শিক্ষার অধিকারে যে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রে কোনও তফাত নেই, এই সহজ সত্যের পক্ষে।
এই সত্যটি ইতিহাসেরই সত্য। উনিশ শতকের জাতপাতলাঞ্ছিত মহারাষ্ট্রকে সমসময়ের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারপীড়িত বাংলার আয়নায় দেখলে তবু জ্যোতিরাও-সাবিত্রীবাই ফুলের লড়াইকে বুঝতে পারা কিছুটা সহজ হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক, বয়সে তাঁর থেকে কয়েক বছরের ছোট জ্যোতিরাও নিজে উনিশ শতকের মহারাষ্ট্রে চরম দুর্দশা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন ‘নীচজাতি’ পরিচয়ের কারণে। তাঁকে যাঁরা লাঞ্ছনা করেছিলেন তাঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন এ তথ্য তর্কাতীত, কারণ সমাজটাই ছিল ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত ও ব্রাহ্মণ্যবাদী। ইংরেজ শাসনের হাত ধরে বাংলার মতোই মহারাষ্ট্রেও পাশ্চাত্যশিক্ষা তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার হয়, উচ্চবর্ণের পাশাপাশি তথাকথিত নিচুজাত ও প্রান্তিক মানুষও তার আলো পান। জ্যোতিরাও এরই ফসল। পরে এই ব্রিটিশরাই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদাভেদ বজায় রেখেছিল সে অন্য কথা, কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষাই যে প্রকৃত সমাজ-সংস্কার, অসাম্প্রদায়িকতা, উদারতা ও মানবতার সিঁড়ি, জ্যোতিরাও সেই সারসত্য বুঝেছিলেন। সহধর্মিণী সাবিত্রীবাইকেও করে তুলেছিলেন স্বপথের পথিক, আজ তাঁকে অভিহিত করা হয় ‘ভারতের প্রথম নারী শিক্ষিকা’ বলে। এই চলার পথ ফুলে ঢাকা ছিল না, ছিল কাঁটায় ভরা। সিনেমার ট্রেলারে সাবিত্রীর দিকে গোবর ছুড়ে মারার মতো দৃশ্য সেই অজস্র প্রতিবন্ধকতারূপ হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এই দৃশ্য যদি আজকের ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী তথা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আঁতে ঘা দেয় তবে ছবিটিকেই সার্থক বলতে হয়— ইতিহাসের সত্য সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বলে। গত মার্চেই মহারাষ্ট্র বিধানসভায় জ্যোতিরাও-সাবিত্রীবাই ফুলেকে ‘ভারতরত্ন’ সম্মান অর্পণের প্রস্তাব পাশ হয়েছে সর্বসম্মত ভাবে। তার বিপরীতে, কিছু ইতিহাস-অন্ধ গোষ্ঠীর একটি ছবির বিরুদ্ধাচরণ নিতান্ত অর্বাচীনতা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)