একটা-দুটো নয়, কলকাতা থেকে উঠে যাচ্ছে উনিশটা ডাকঘর। এ হয়তো হওয়ারই ছিল। এখন হাতে-হাতে মোবাইল ফোন, আইসল্যান্ড থেকে নিউ জ়িল্যান্ড সর্বত্র প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে ‘ভিডিয়ো কল’ করা যায় সামান্য খরচে। টেলিগ্রাম, ফ্যাক্স মেশিনের দিন কবেই গিয়েছে। ক্রমশ কেজো প্রয়োজন থেকে সরে যাচ্ছে হলুদ পোস্টকার্ড, নীল ইনল্যান্ড লেটার, রঙিন খাম, ডাকটিকিট। তাদের স্থান হচ্ছে ‘বাতিকবাবু’-দের সংগ্রহালয়ে, দু’পয়সা-পাঁচ পয়সার মুদ্রার মতো। বাণিজ্যিক চিঠি, পত্র-পত্রিকা, পার্সেল— এই এখন ডাকঘরের প্রধান পসরা। ব্যক্তিগত চিঠি, যাতে লেখা থাকে প্রেমিকার অদর্শনে প্রেমিকের আকুলতা, মননশীল বন্ধুর সুচিন্তিত মতামত, মায়ের আশীর্বাদ এবং নানা সতর্কবাণী, সংসারের পরিস্থিতি বর্ণনা করে গৃহিণীর অভিমান-ভরা আখ্যান— এখন কাগজ-কলম থেকে সরে যাচ্ছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। কাজেই উঠে যাচ্ছে গোলগাল, টাক-মাথা, টকটকে লাল ডাকবাক্সরাও। প্রহরীর মতো বড় বড় রাস্তার মোড়ে তাদের আর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। আগে বাড়ির বাইরে লাগানো ‘লেটার বক্স’-ও ছিল গৃহস্থের পরিচয়। বিত্তবানের বড়সড়, সুদৃশ্য বাক্স, ছাপার অক্ষরে নাম। আর ছাপোষা গেরস্তের রংহীন কাঠের বাক্স, আঁকাবাঁকা অক্ষরে পদবিটুকু লেখা। পথচলতি লোকও আন্দাজ পেতেন, কারা কারা থাকে ভিতরে। এখন চিঠি ফেলার বাক্স স্থান পেয়েছে আবাসনের ভিতরের দেওয়ালে, বাইরে থেকে অদৃশ্য। মনে পড়ে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর দু’দুটো রহস্য কাহিনিতে প্রায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছিল চিঠির বাক্স। ‘মণিমণ্ডন’ গল্পে গৃহভৃত্যটি গয়নার বাক্স চুরি করে রেখে দিয়েছিল বাড়ির বাইরের চিঠির বাক্সে, পর দিন তার ডাককর্মী দাদা সেটি নিয়ে যাবে আর পাঁচটা চিঠির সঙ্গে, এই মতলবে। আর ‘বহ্নি পতঙ্গ’ গল্পে স্বামীহত্যায় ষড়যন্ত্রকারী শকুন্তলা তার প্রেমিক, তথা স্বামীর আততায়ীর নাম চিঠিতে লিখে গভীর রাতে ডাকবাক্সে ফেলতে গিয়ে গুলিতে নিহত হয়, প্রেমিকেরই হাতে।
এ হয়তো কল্পকাহিনি, কিন্তু চিঠিকে কেন্দ্র করে কত নাটক অভিনীত হয়েছে ঘরে ঘরে, একের চিঠি অন্যের হাতে পড়ে কত অনর্থ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। জীবন থেকে তা স্থান পেয়েছে রুপোলি পর্দাতেও। কে ভুলতে পারে সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে মলিনা দেবীর প্রবীণা গৃহিণীর চরিত্রটিকে, মেস-পরিচালক স্বামীর (তুলসী চক্রবর্তী) পকেট থেকে এক তরুণীর লেখা প্রেমপত্র পেয়ে যিনি কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, পুরনো দাম্পত্যে ফের রোম্যান্স ফিরিয়ে আনতে? আসলে কাগজে-কলমে লেখা হলে চিঠি কেবল দুটো মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। একের চিঠি অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাঝে থাকেন আরও কয়েক জন। কখনও তাঁরাই এক-একটা চরিত্র হয়ে ওঠেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ যেন আজও ছুটে চলেছে আমাদের মনে, সলিল চৌধুরীর সুর আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের ঝঙ্কারে। আর একটি মনোরম ছবি তৈরি হয়েছিল ইটালিতে, নাম দ্য পোস্টম্যান। পাবলো নেরুদা তাঁর রাজনৈতিক মতামতের জন্য নিজের দেশ চিলি ছেড়ে কিছু দিন ছিলেন ইটালিতে। এই সত্য ঘটনাকে নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রে দেখা গেল, গোছা গোছা চিঠি নেরুদাকে পৌঁছে দিতে রাখা হয়েছে এক তরুণকে। সাদামাঠা, স্বল্পশিক্ষিত সেই তরুণ নেরুদার সান্নিধ্যে এসে ভালবাসতে শিখল কবিতাকে। চিঠি তার আসা-যাওয়ার পথে এমন কত সেতু গড়ে।
বহু চিঠি তাঁর প্রাপককে অতিক্রম করে বার্তা বহন করেছে মানবসমাজের জন্য। আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর পুত্রের শিক্ষককে চিঠিতে লিখেছিলেন, “ওকে শেখাবেন, কুড়িয়ে-পাওয়া ডলারের চাইতে খেটে উপার্জন করা দশ সেন্ট অনেক মূল্যবান... টুকে পাশ করার চাইতে ফেল করা অনেক সম্মানের।” চিঠিটি বিশ্বে সর্বত্র সমাদৃত। বাংলার বিপ্লবীরা জেলে বসে যে চিঠিগুলি লিখেছিলেন পরিবারের মানুষদের কাছে, তা আজও দেশপ্রেম, দেশের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। সরলা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা মহাত্মা গান্ধীর চিঠিগুলি দেশবাসীর কাছে উন্মুক্ত করে এক অন্য গান্ধীকে। সেখানে তিনি ‘বাপু’ নন, ‘আত্মার সহচরী’ সন্ধানরত এক পুরুষ। সংশয় হয়, এঁরা যদি পরস্পরকে ইমেল লিখতেন, তবে কি উত্তরপ্রজন্ম নাগাল পেত তাঁদের কথাবার্তার? না কি পাসওয়ার্ডের দারোয়ানি এ সব অমূল্য সম্পদকে চিরবন্দি করত ‘ক্লাউড’-এ? ডিজিটাল প্রযুক্তির তাৎক্ষণিকতা আমাদের আপাত-লাভের অন্তরালে কী কী ক্ষতি করছে, তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)