এক ১৭ বছরের কিশোর পিতাকে পুলিশ গ্রেফতার করায় ‘পকসো’ (প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস, ২০১২) আইনের প্রয়োগ-বিধি নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ১৬ বছরের নাবালিকা মা পুলিশকে জানিয়েছে, ওই কিশোরের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে সে ‘বিয়ে’ ও গর্ভধারণ করেছে নিজের সম্মতিতে। এ ক্ষেত্রে প্রথম কথাই হল, আইন অনুসারে দেশে যেখানে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর, সেখানে কোনও নাবালিকা ‘স্বেচ্ছা’য় বিয়ে করল কি না, সেটা বিবেচ্য হতে পারে না। নাবালিকার বিবাহ আইনে নিষিদ্ধ, তা দণ্ডনীয় অপরাধ। পকসো আইনের অবস্থান কঠোরতর— শিশুদের যৌনহয়রানি থেকে সুরক্ষার জন্য নির্মিত পকসো আইনে নাবালিকার যৌনসংসর্গ মাত্রই ধর্ষণ। অতএব কিশোর পিতার বিরুদ্ধে পকসো এবং বাল্যবিবাহ রোধ আইনে মামলা করেছে পুলিশ। খাস কলকাতার হেস্টিংস অঞ্চলে নাবালিকার বিয়ে ও সন্তান প্রসবের ঘটনাটি নিয়ে বিচলিত রাজ্যের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনও। কমিশন জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে আইন মানা ছাড়া প্রশাসনের করার কিছু নেই। অনেক সময়ে নাবালিকা বিয়ের সঙ্গে পাচারের মতো অপরাধও জড়িয়ে থাকে, তাই তাকে লঘু করে দেখা চলে না। বাল্যবিবাহ তথা নাবালিকার উপর যৌননির্যাতন বিশেষ অপরাধ, তার জন্য কঠোর শাস্তিই বিধেয়। অতএব পুলিশ-আদালত যে নাবালিকার সুরক্ষায় সক্রিয়, তৎপর হবে, এমনই প্রত্যাশিত।
গভীরতর প্রশ্নটি হল, অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীর যৌনতা, বা সন্তানধারণকে আইন কী চোখে দেখবে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী হবে? আইনে বিবাহের ন্যূনতম বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর ধার্য করার পিছনে যে যুক্তিগুলি রয়েছে, এ ক্ষেত্রে সেগুলিকে ফিরে দেখা যায়। বিবাহ বা সন্তানধারণের জন্য শরীর এবং মনের যে পরিণত রূপ প্রয়োজন, তা অর্জন করার আগেই যদি মেয়েরা সে পথে হাঁটে, তবে তা তাদের অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে। সে ক্ষতি মানবসম্পদের, অতএব সমাজের— ফলে, ব্যক্তির স্বাধীনতা হিসাবে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া চলে না। কেউ বলতে পারেন, এই বিশ্বায়িত সংস্কৃতির যুগে ছেলেমেয়েদের যৌনতা থেকে আটকে রাখা কার্যত অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে বিষয়টির সমস্যা, সম্ভাব্য বিপদ, প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচার এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা চাই। সে দায়িত্ব সমাজের, প্রশাসনের। কিন্তু, যে ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক যুগল পরস্পরের সম্মতিক্রমেই মিলিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও কি পকসো আইন প্রয়োগ যথাযথ? অনস্বীকার্য যে, সম্মতির বিষয়টি বহুস্তরীয় এবং ধূসর— সংশ্লিষ্ট মেয়েটি বিবিধ চাপে সম্মতির কথা বলতে পারে। কিন্তু, সত্যই যদি সম্মতি থাকে, তবুও কি এই যৌনতাকে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করাই বিধেয়?
এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিচারের অবকাশ রয়েছে। বিভিন্ন হাই কোর্ট, এবং সুপ্রিম কোর্টও নানা মামলায় আইনের আক্ষরিক পালনের চেয়ে নাবালিকা ও তার সঙ্গীর ন্যায় পাওয়ার অধিকারকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। কেরল এবং বম্বে হাই কোর্ট নাবালিকার সম্মতিকে গুরুত্ব দিয়ে, অভিযুক্তকে পকসো-র আরোপ থেকে মুক্ত করেছে। যেখানে নির্যাতনের প্রমাণ নেই, সেখানে পকসো-নির্দিষ্ট কঠোর শাস্তি দেওয়া অনুচিত বলে মনে করেছেন বিচারপতিরা। সুপ্রিম কোর্ট এ বছরেই পশ্চিমবঙ্গের এক নাবালিকা ও তার সন্তানের সুস্থ জীবনের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে এক পকসো-অভিযুক্তকে নির্দোষ ঘোষণা করেছে। কিন্তু মনে করিয়েছে যে, নাবালিকার বিবাহ ও মাতৃত্বকে প্রশাসনিক, সামাজিক ও বিচার ব্যবস্থার সম্পূর্ণ ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত বলে ধরতে হবে। আক্ষেপ, এই ব্যর্থতার দায় নাবালিকার উপরে চাপাতে চায় পুলিশ-প্রশাসন। মনে রাখতে হবে যে, শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে পকসো আইনের গুরুত্ব বিপুল, কিন্তু তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা এবং সুবিবেচনা প্রয়োজন। নির্যাতন আর সম্মতির মধ্যে ফারাক করতে পারা ন্যায়বিচারের পথে প্রথম ধাপ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)