কাজের জন্য জীবন, না জীবনের জন্য কাজ? সদা কর্মব্যস্ততা যেন এক ধূসর কম্বলের মতো জড়িয়ে দম আটকে দিচ্ছে অগণিত মানুষের। সময়ের অভাবে সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে, ‘প্যানিক অ্যাটাক’ শব্দবন্ধ ঢুকে পড়েছে বাঙালির মুখচলতি কথায়। সারা দিন নিজেকে নিংড়ে দিয়েও রাতে ভয়— কাজ যদি সময় মতো শেষ না হয়? কতটা কাজ করলে তবে কর্মী বলা যায়, তা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কয়েক মাস আগে ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণমূর্তি সপ্তাহে সত্তর ঘণ্টা কাজ করতে আহ্বান করেছিলেন দেশের তরুণদের। তার ক’দিন পরেই আরও এক ধাপ এগিয়ে নব্বই ঘণ্টা কাজের সওয়াল করেন লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর চেয়ারম্যান এস এন সুব্রহ্মণ্যন। এমন অত্যুচ্চ প্রত্যাশায় আপত্তি করেছেন অনেকে। অতিরিক্ত কাজের চাপে কর্মশক্তি নিঃশেষিত (বার্নআউট) হওয়ার জন্য কাজ ছেড়ে দেওয়ার হার ভারতে এমনিতেই চড়া। একটি অসরকারি সংস্থার স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছে, ভারতে কাজের ক্ষেত্রে ‘বার্নআউট’-এর হার প্রায় ৬০ শতাংশ, যেখানে বিশ্বের গড় ২০ শতাংশ। কর্মজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার, এমন ধারণাকে কখনওই বিশেষ আমল দেননি ভারতের নিয়োগকর্তারা। তাই ছুটির দিনে প্রশিক্ষণ, জনসংযোগমূলক অনুষ্ঠান, সারা দিন কাজের পরে রাতে অনলাইন মিটিং, এগুলি বেসরকারি ক্ষেত্র ছাড়িয়ে সরকারি কাজেও প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে তো কথাই নেই— বিরতিহীন ‘ডাবল ডিউটি,’ উৎপাদনের লক্ষ্যপূরণ করতে ওভারটাইম, দিনে বারো-চোদ্দো ঘণ্টা শ্রম, এ সবই নিয়োগের শর্ত হয়ে উঠেছে।
এমন অবিচ্ছিন্ন, দীর্ঘ সময়ের কাজ কি উৎপাদনশীলতার পক্ষে ভাল? সম্প্রতি একটি তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা সংস্থার শীর্ষ কর্তা অশ্বিন ইয়ার্দি বলেছেন, সপ্তাহে পাঁচ দিন মোট ৪৭.৫ ঘণ্টা কাজই যথেষ্ট। ইয়ার্দি বা তাঁর সংস্থার কেউ সপ্তাহান্তে কাজ করেন না, এমনকি কাজ-সংক্রান্ত ইমেল পাঠানোও নিষেধ। পরিমিত কাজ, যথেষ্ট বিশ্রাম, বিনোদনের প্রয়োজনকে কিছু সংস্থা এমন গুরুত্ব দেয়। তা কেবল মানবিকতা বা নৈতিকতার খাতিরে নয়। তার কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি-সহ নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজন কর্মীদের কল্পনাকুশল, সৃজন-উন্মুখ মন। নানা ধরনের উদ্ভাবনী চিন্তা, সমস্যা সমাধানের বিকল্প উপায় অনুসন্ধানের ক্ষমতা, এগুলি কর্মীদের মধ্যে না থাকলে বাজারে নতুন জমি দখল করতে পারবে না ওই সব সংস্থা। কর্মভারে ক্লান্ত মন তা পারবে কী করে? কর্মীদের তরতাজা, সদা-তৎপর রাখতে বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির দফতরে বিশ্রাম, বিনোদন, খেলাধুলো, খাওয়া-দাওয়ার অঢেল ব্যবস্থা মজুত থাকে। আরামপ্রদ, চিত্তাকর্ষক ভাবে সাজানো হয় দফতর, দফতরে আসা-না আসার সিদ্ধান্ত অনেকটাই থাকে কর্মীদের হাতে। নতুন জায়গায় ঘোরা, নতুন বই পড়া, নতুন লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, এ সবই ক্লান্ত মগজকে আবার চাঙ্গা করতে পারে। তবে ‘শিয়রে শমন’ অবস্থা হলে রাশ টানতে দেখা যায় কর্তাদের। কৃত্রিম মেধা-চালিত অ্যাপ তৈরির ইঁদুরদৌড়ের তাড়ায় গুগল-এর অন্যতম কর্তা সার্গে ব্রিন সম্প্রতি সপ্তাহে ষাট ঘণ্টা কাজ দাবি করছেন। এআই ইঞ্জিনিয়ারদের চিঠি দিয়েছেন, এগিয়ে থাকতে হলে সপ্তাহে তিন দিন নয়, পাঁচ দিন অফিসে আসুন।
কর্মীর শ্রমক্ষমতাই শিল্পের ইন্ধন। কিন্তু কর্মীটিকে দেখছে কে? যে কাজ মানুষ ভালবেসে করে, যাতে সে প্রাণের প্রণোদনা পায়, তাতে কোনও পরিশ্রমই অতিরিক্ত মনে হয় না। কর্মব্যস্ত দিনের শেষেও সে বসে পড়ে সেলাই নিয়ে, কিংবা লেগে যায় বাগানের পরিচর্যায়। কিন্তু মনের আরাম মেলে, এমন কাজ আর কত? উপভোক্তা-সংস্কৃতি মানুষকে বেঁধে ফেলেছে এক ভিন্ন চক্রে। ঋণ করে কেনাকাটা, আর তা মেটানোর জন্য আরও কাজ— এই ঘুরপাকে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে বহু লোক। উরুগুয়ের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা জিডিপি বাড়ানোর তাগাদা না দিয়ে বলেছিলেন, অবসর সময় যেন গ্রাস না করতে পারে অর্থকরী কাজ। সতর্ক করেছিলেন, মানুষ যদি নিজের জীবনের অর্থ নিজে খুঁজে বার না করতে পারে, তা হলে ঋণ মেটানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতেই এক দিন তার হৃৎপিণ্ড জবাব দেবে। মুহিকা মনে করিয়েছেন, মানুষের হাতে স্বাধীন সময় না থাকা মানেই মানুষের স্বাধীনতা না থাকা। রবীন্দ্রনাথ রম্যাঁ রলাঁকে চিঠিতে (২৮-২-১৯২৪) লিখছেন, “আমি চাই না আমার জীবনের অস্তবেলা শ্রমসাধ্য কাজের ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে থাক, এমন কাজ যা নিজের পশ্চাৎপটের অনন্ত শান্তিকে অনবরত গ্রাস করে।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)