E-Paper

গানের ও-পারে

রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষত ‘আমার সোনার বাংলা’র গুরুত্ব যে শুধু একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত বলে নয়, অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ রূপে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালির গর্বের জায়গা, সে কথা বহু বার সমাজ-রাজনীতিতে আলোচিত।

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:২৪

অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা অগ্নিশর্মা হয়েছেন, তাঁর রাজ্যে প্রতিবেশী দেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গীত বা উচ্চারিত হচ্ছে বলে। রাজারাজড়ার কাল হলে হয়তো শূলে চড়াতেন, তবে আজকের বিজেপি-শাসিত, আরএসএস-পোষিত ভারতে পান থেকে চুনটি না খসতেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহ!’ বলে আস্ফালন এবং কালবিলম্ব না করে ইউএপিএ-গোছের আইনে ফাঁসানোই শূলে চড়ানোর সমার্থক, বিরোধী রাজনৈতিক দল বা আদর্শের লোক হলে তো কথাই নেই। তাই কংগ্রেসের দলীয় সভায় ওই গানটি যাঁর মুখে উচ্চারিত হল এবং যাঁরা তা শুনলেন, সকলের বিরুদ্ধে পুলিশকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করতে বলেছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। ২০১৪-র কলকাতায় এসে আর এক নেতা তাঁর বক্তৃতা শুরুই করেছিলেন অবাঙালি টানে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ উচ্চারণ করে, অনশ্বর ডিজিটাল যুগে সেই ভিডিয়ো এখনও চাইলে দেখে নেওয়া যায়। সেই নেতা— ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেও তবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ খাটে নিশ্চয়ই! হিমন্তবিশ্ব শর্মারা বলতে পারবেন।

রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষত ‘আমার সোনার বাংলা’র গুরুত্ব যে শুধু একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত বলে নয়, অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ রূপে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালির গর্বের জায়গা, সে কথা বহু বার সমাজ-রাজনীতিতে আলোচিত। হিমন্তবিশ্ব শর্মাদের সে কথা আবারও বোঝানো যেতে পারে, বোঝানো দরকারও, তবে যে বুঝেও না বোঝার পণ করেছে, তার অন্য স্বার্থ বা অভিসন্ধি আছে বুঝতে হবে। এত দিনে নানা ভাবে ও রূপে বিজেপি-আরএসএস’এর সেই অভিসন্ধিটি স্পষ্ট: যখন যেখানে দরকার ধর্ম, জাতি, ভাষা বা সংস্কৃতি দিয়ে বিভেদ-বিভাজনের পথটিই তাদের পথ। এই বিভাজনের রাজনীতিতেই কখনও মুসলমান, কখনও বাঙালি, কখনও খাদ্যাভ্যাস, পোশাক বা রবীন্দ্রনাথের গানও তাদের কাছে এ-কালের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর অস্ত্র। বিজেপি-শাসিত ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক বিরোধী, তাই ‘বাংলা’ সব কিছুই এখন তাদের চক্ষুশূল— তা সে যুগ যুগ ধরে অসমে বসবাস করা বাঙালিই হোক কিংবা ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়া বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক। ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবনতির কালে তাদের তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে ‘বাঙালি=বাংলাদেশি’ এই বয়ানের প্রচার, কয়েক প্রজন্মের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদেরও ঠেলে পাঠানো হচ্ছে কাঁটাতারের ও-পারে। কয়েক মাসের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, গত কাল থেকে শুরু হয়েছে এসআইআর-ও, বাংলা ও বাঙালিকে যেন তেন প্রকারেণ চাপে রাখার রাজনীতি বাড়ছে স্বাভাবিক ভাবেই— বিজেপির এক সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ছক।

রাজনীতি শুধু মাঠে-ময়দানেই হয় না। ভাষা-সংস্কৃতির মতো ‘সফট পাওয়ার’কে হাতিয়ার করাও আজকের ভারতের, বিশেষত আরএসএস-বিজেপি’র বহুচর্চিত কৌশল। বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহ ঠাহরাচ্ছেন, তখন তার সমর্থনে খাস পশ্চিমবঙ্গেই এক বিজেপি নেতা রীতিমতো হুমকি দিচ্ছেন— ‘২০২৬-এর পর’ এ রাজ্যেও এই গান গাওয়া চলবে না। ঔদ্ধত্যের সীমা কত দূর ছাড়ালে রবীন্দ্রনাথের শহরে বসেই এ কথা বলা যায় তা অন্য প্রশ্ন, আসল কথা হল— এর সমুচিত কোন উত্তর বাঙালি দেবেন, এবং কী ভাবে। একশো কুড়ি বছর আগে এক বিভেদকামী রাষ্ট্রশক্তির বঙ্গভাগ-ঘোষণার প্রতিক্রিয়াতেই রচিত হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠা তো তুলনায় এই সে-দিনের ঘটনা। আজ আর এক বিভাজনসর্বস্ব রাষ্ট্রশক্তি যখন বাঙালিকে আক্রমণে উদ্যত, তখন আবারও তা প্রতিহত করতে হবে— নির্বাচনী রাজনীতির ময়দানে, বাঙালির সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore Tagore Song Bengali Song Bengali Culture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy