পশ্চিমবঙ্গের সব পুর এলাকায় হকার সমীক্ষা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রের বিধি মেনে নথিবদ্ধ প্রত্যেক হকার-পরিবারের আর্থ-সামাজিক খুঁটিনাটি তথ্য নেওয়ার কাজ শুরু করেছে নবান্ন। হকারদের জন্য কেন্দ্র সুলভ ঋণ-সহ যে সব সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তার যথাযথ রূপায়ণের জন্য সমীক্ষাটি প্রয়োজন, নচেৎ নগরোন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে রাজ্যের নিজস্ব তাগিদও রয়েছে। গত বছর জুন মাসে কলকাতার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিল পুরসভা। অতীতের কয়েকটি উদ্যোগের যা হাল হয়েছিল, গত বছরেও তেমনই হয়েছে— অর্থাৎ, কিছু দিন ভাঙচুর, প্রতিবাদ, শোরগোলের পরে আবার হকাররা স্বস্থানে ফিরে এসেছেন। ফুটপাতের দুই-তৃতীয়াংশ ছেড়ে রাখতে হবে, কোনও দোকানের প্রবেশদ্বারের সামনে বসা চলবে না, শহরের কয়েকটি এলাকাকে হকারদের জন্য নিষিদ্ধ করা হবে, এ সব সরকারি নীতির কোনও ছাপ শহরের রাস্তায় চোখে পড়ে না। তাই প্রশ্ন ওঠে, যদি বা হকার সমীক্ষা হয়, এবং কিছু হকারকে ‘বৈধ’ বলে চিহ্নিত করা হয়, তার কী লাভ আশা করা যেতে পারে? সরকারি শংসাপত্র পাওয়া হকাররা কেন্দ্রের প্রকল্পে ঋণ এবং অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন, এটা নিঃসন্দেহে একটা সুবিধা। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্রে খবর, এখনও অবধি পশ্চিমবঙ্গের তিন লক্ষ হকার আবেদন করেছেন ঋণের জন্য, দু’লক্ষ উপভোক্তা ঋণ পেয়েছেন। কেবল কলকাতাতেই যেখানে হকারের সংখ্যা দু’লক্ষের বেশি, সেখানে এই সংখ্যা আশাজনক নয়। কেন্দ্র-নির্দিষ্ট সমীক্ষার পরে সংখ্যাটা কিছু বাড়তে পারে। যদিও সেই অনুদান-প্রাপ্তদের পিছনে থেকে যাবেন অসংখ্য ‘অবৈধ’ হকার, তা প্রায় নিশ্চিত।
সরকারি প্রকল্পের টাকা পাবেন কে, তার নামের তালিকা তৈরি করা ইদানীং প্রশাসনের কাজের তালিকার শীর্ষে চলে এসেছে। তাতে হকার বা নাগরিকদের প্রধান সমস্যাগুলো মিটবে না। নাগরিকের প্রধান সমস্যা যাতায়াতে বাধা— ফুটপাত এবং রাস্তায় হকারের উপস্থিতি অতিরিক্ত হয়ে গেলে পথচারী ও গাড়ি চালক, সকলেরই গতি কমে, ঝুঁকি বাড়ে। আবার, সুলভে এবং সহজে কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়ার জন্য বহু মানুষ হকারদের উপরে নির্ভরশীল, তাই কোনও রাস্তা হকারশূন্য হলে, বা হকার বেশি দূরে চলে গেলেও উপভোক্তা হিসাবে বহু নাগরিক সমস্যায় পড়েন। অন্য দিকে, হকাররা পুলিশি হয়রানি, তোলাবাজি, হঠাৎ-উচ্ছেদ থেকে রেহাই চান। স্বস্তিতে জীবিকা অর্জনের সুযোগ চান। কিন্তু আইন করে সেই সুরক্ষা দেওয়া কার্যক্ষেত্রে অসম্ভব। প্রথমত, হকারদের বৈধতার শর্তগুলি এক এমন আলো-আঁধারি তৈরি করেছে, যাতে প্রায় কোনও হকারই আইনের সব শর্ত মেনে সম্পূর্ণ বৈধ হয়ে উঠতে পারেন না। তাঁর দোকান ফুটপাতের এক-তৃতীয়াংশ ছাড়াল কি না, পাকা কিংবা আধ-পাকা ছাউনি তৈরি করল কি না, অন্যের থেকে স্টল ভাড়া নিয়ে দোকান কি না, বিদ্যুৎ সংযোগ অবৈধ কি না, এমন অজস্র প্রশ্ন থেকে যায়। বৈধতার শংসাপত্র থাকলে পুনর্বাসনে অগ্রাধিকার থাকতে পারে, উচ্ছেদ থেকে নিস্তারের নিশ্চয়তা নেই।
অন্য দিকে, উচ্ছেদ করলেও বার বার ফিরে আসবেন অবৈধ হকাররা। জীবিকা অর্জনে তাঁরা মরিয়া। তাঁদের আইনের জোর নেই, রয়েছে সংখ্যার জোর, যা অস্বীকার করতে পারে না দলীয় রাজনীতি। ফলে উচ্ছেদ করতে চেয়েও বার বার পিছু হটতে হয়েছে প্রশাসনকে। পুলিশ ও স্থানীয় বাহুবলী নেতাদের তোলাবাজির চক্রও অবৈধ হকারদের টাকাতেই চলে। অতএব সুষ্ঠু হকার নীতি কেবল আইনের দ্বারা পরিচালিত হলে কার্যকর হবে না। নগর-ভূগোলের সুচিন্তিত ব্যবহার সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। দিন ও সন্ধ্যার নানা সময়ে নগরের নানা স্থানের ব্যবহারের নীতি, চলমান যান থেকে বিক্রয়ে উৎসাহ, দূষণ ও জঞ্জাল নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির উপর জোর দিতে হবে। উচ্ছেদ-পুনর্বাসনের বাইরে আর কী করা যায়, সেই চিন্তার সময় এসেছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)