তিন বছর কম সময় নয়। লক্ষ্য যদি হয় শহর থেকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উৎসে পৃথক করা বর্জ্য সংগ্রহ ও তার একাংশকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা, তবে এই সময়কালের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কাজটি মোটেই অ-সম্ভব নয়। কিন্তু কলকাতা সে কাজ পারল না। এমন নয় যে তার পরিকাঠামো একেবারেই নেই। পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজটি শুরু হয়েছে আগেই। ধাপায় বিশেষ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু নাগরিকের বাড়ি থেকে ধাপার ইউনিট অবধি বর্জ্য পৌঁছনোর মধ্যের ধাপগুলিকে এখনও নিয়মে বাঁধা গেল না। ধাপার বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটটি শুধুমাত্র উৎসে পৃথক করা বর্জ্য নিয়েই কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মিশ্র বর্জ্য, যা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এই ধারাবাহিক অব্যবস্থার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন।
মিশ্র বর্জ্যের বিপদ দু’জায়গায়। এক দিকে, এই বর্জ্যের মধ্যে গৃহস্থের রান্নাঘর-নিঃসৃত আনাজপাতির খোসা, ফল-খাবারের টুকরোর মতো পচনশীল বস্তুর সঙ্গে প্লাস্টিক, কাগজ, ধাতু মিশ্রিত থাকায় ধাপার ইউনিটটি তাকে ব্যবহার করে সার তৈরি করতে পারে না। অন্য দিকে, প্লাস্টিকের সঙ্গে পচনশীল বস্তু মিশে থাকায় সেটিও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের কাজটিও থমকে থাকে। আধুনিক শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক শর্ত প্রতি দিন বর্জ্য সংগ্রহের পাশাপাশি উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণ, এবং বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তাকে পুনর্ব্যবহারের যথাসম্ভব প্রচেষ্টা নেওয়া। এতে শহরে বর্জ্যের পরিমাণ কমে, পরিবেশ বাঁচে, নাগরিকও। কিন্তু কলকাতা এখনও সেই পথে হাঁটতে পারেনি। পুরসভা নানা সময় উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প গ্রহণ করলেও কোনওটিই বাস্তবে কার্যকর হয়নি। শুধুমাত্র কলকাতা পুরসভা অঞ্চলে প্রতি দিন উৎপন্ন হয় ৪,৫০০ টন বর্জ্য। এর মধ্যে মাত্র ১,১০০ টনের কিছু বেশি বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় এখনও যথেষ্ট কম। বাকি অংশ নানা জায়গায় বেআইনি ভাবে জমা হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে যতটুকু পরিকাঠামো হাতে আছে, ততটুকুকেও যদি কাজে লাগানো না যায়, তবে আধুনিক শহরের গর্ব করার জায়গা কোথায়?
কলকাতার মেয়র মহাশয় হামেশাই নাগরিকের অসচেতনতা বিষয়ে আক্ষেপ করেন। কিন্তু সচেতনতা কেন নেই, না থাকলে পুর-প্রশাসন কেন কখনও কঠোর পদক্ষেপ করে না, উত্তর পাওয়া যায় না। এ বারও তিনি জরিমানার পথ ধরতে চাননি। বরং পুরসভা পুরবাসীকে সচেতন করতে জিঙ্গল বেঁধেছে। কলকাতার আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক সমাজ পরিবেশ দূষণ বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ— এমনটি ভাবার কারণ নেই। তা সত্ত্বেও যদি তাঁরা পুরসভা প্রদত্ত দু’ধরনের বর্জ্য ফেলার দুই রঙা বালতিগুলিকে সংসারের অন্য কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন, তবে এই জিঙ্গলের সুরেই তাঁরা নড়েচড়ে বসবেন— এমন ভাবনা অবাস্তব। প্রয়োজন, ধারাবাহিক ভাবে নিয়ম অমান্যকারীদের উপর মোটা জরিমানা ধার্য করা, প্রয়োজন বর্জ্য সংগ্রাহকদের মিশ্র বর্জ্য গ্রহণ না করায় স্থির থাকা। নাগরিকের স্বেচ্ছায় নির্বোধ সেজে থাকা আর প্রশাসনের জনমোহিনী রাজনীতির ভেক ধরা— পরিবেশের পক্ষে উভয়েই সমান ক্ষতিকর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)